অরূপ চক্রবর্তী, গুয়াহাটি: বিশ্বের সর্বাধিক বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চল সোহরায়, যা একসময় চেরাপুঞ্জি নামে পরিচিত ছিল, 5G ও 6G যোগাযোগ ব্যবস্থার মানোন্নয়নে যুগান্তকারী গবেষণা শুরু করেছে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (NIT) মেঘালয় এবং নর্থ ইস্টার্ন স্পেস অ্যাপ্লিকেশন সেন্টার (NESAC)। চলতি বছরের শুরুতে এনআইটি মেঘালয় তাদের স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তরিত হওয়ার পর গবেষকদল সোহরার অতিবৃষ্টি, অস্বাভাবিক বড়ো বৃষ্টিবিন্দু এবং তীব্র বর্ষার প্রকৃতি দেখে যেমন মুগ্ধ, তেমনি যোগাযোগ ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ নিয়েও বিস্মিত হয়েছে।
প্রকল্পে যুক্ত এক বিজ্ঞানী জানান, সোহরার বৃষ্টিপাতের তীব্রতা ও প্রতিটি বৃষ্টিবিন্দুর আকার পৃথিবীর অন্য যে কোনো স্থানের তুলনায় একেবারেই আলাদা। এর ফলে যোগাযোগ সিগন্যাল প্রায়শই বিঘ্নিত হয় এবং প্রচলিত নেটওয়ার্ক মডেলগুলো কার্যকর থাকে না। এনআইটি মেঘালয়ের অ্যাকাডেমিক বিষয়ক ডিন ড. অনুপ দণ্ডপাট বলেন, তাঁদের গবেষণার লক্ষ্য হল সোহরার চরম আবহাওয়াকে প্রতিবন্ধক হিসেবে নয়, বরং সম্ভাবনার ক্ষেত্র হিসেবে কাজে লাগানো।
ড. দণ্ডপাটের কথায়, “আমরা চাই ভারী বর্ষাকে সমস্যা হিসেবে নয়, বরং গবেষণার সুযোগ হিসেবে দেখতে। প্রতিটি বৃষ্টিবিন্দু কী ভাবে উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সির সংকেতের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে, তা বোঝা গেলে এমন যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব, যা আরও অভিযোজ্য, স্থিতিশীল এবং চরম আবহাওয়ার মধ্যেও কার্যকর থাকবে। এই প্রযুক্তি শুধু মেঘালয় নয়, বর্ষাপ্রবণ বিশ্বের বহু অঞ্চলের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।”
সোহরার অস্বাভাবিক বড় বৃষ্টিবিন্দু ও প্রায় অবিরাম বৃষ্টিপাতের প্রভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে বিজ্ঞানীরা একটি বিশদ গবেষণা শুরু করেছেন। এই গবেষণায় তাঁরা অনুসন্ধান করছেন সংকেত প্রেরণে কী ভাবে বৃষ্টিপাত প্রভাব ফেলে এবং ভবিষ্যতের 5G ও 6G নেটওয়ার্কগুলোকে কী ভাবে সেই প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো যায়। গবেষণার লক্ষ্য হল এমন এক ‘বৃষ্টি-সহনশীল’ যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করা, যা বিশেষত পাহাড়ি ও দুর্গম এলাকায় বর্ষাকালে সংযোগ বিচ্ছিন্নতার সমস্যার সমাধান দিতে পারে। মেঘে ঢাকা পাহাড়, জলপ্রপাত ও সবুজ উপত্যকার কোলে অবস্থিত সোহরা বরাবরই কবি ও বিজ্ঞানীদের প্রেরণার উৎস। এখন এনআইটি ও নেসাক দলের কাছে প্রতিটি বৃষ্টিধারা শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য নয়, বরং বৈজ্ঞানিক তথ্যের উৎস হয়ে উঠেছে।
অন্য দিকে, এনআইটি মেঘালয়ের গবেষকরা রাজ্যের প্রথম ইন্টিগ্রেটেড চিপ (IC) সফলভাবে নকশা ও নির্মাণ করে প্রযুক্তিগত আত্মনির্ভরতার পথে নতুন অধ্যায় সূচনা করেছেন। এই চিপটি তৈরি হয়েছে ইলেকট্রনিক্স ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রকের (মিনিস্ট্রি অফ ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি, MeitY) বিশেষ কর্মী উন্নয়ন কর্মসূচির (স্পেশ্যাল ম্যানপাওয়ার ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম, SMDP) অধীনে। প্রকল্পের নেতৃত্বে ছিলেন ড. প্রবীর সাহা, ড. শুভঙ্কর মজুমদার এবং ড. প্রদীপ কুমার রাঠোর। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন পিএইচডি গবেষক গীতিমা কাচারী, পরিশ্মিতা গোস্বামী এবং দেইবাফিরা সুচিয়াং। তাঁরা যৌথভাবে একটি Finite State Machine (FSM) চিপ তৈরি করেছেন, যা ১৮০-ন্যানোমিটার প্রক্রিয়া প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাঞ্জাবের সেমিকন্ডাক্টর ল্যাবরেটরি (SCL) ফাউন্ড্রিতে প্রস্তুত করা হয়েছে।
চিপটি মূলত সেচ ব্যবস্থা ও টেনসিওমিটার নিয়ন্ত্রণে নির্ভুল পরিমাপের জন্য তৈরি করা হয়েছে। গবেষকদলের মতে, এটি ভারতের কৃষিপ্রযুক্তি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে এবং ভবিষ্যতে দেশের কৃষিক্ষেত্রে স্মার্ট টেকনোলজি ব্যবহারের সুযোগ আরও বাড়াবে। সম্প্রতি সেমিকন ইন্ডিয়া ২০২৫ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে এই চিপটি আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এটি এক দিকে ভারতের প্রযুক্তিগত আত্মনির্ভরতার প্রতীক, অন্য দিকে উত্তর-পূর্ব ভারতের অ্যাকাডেমিক গবেষণার সক্ষমতার উজ্জ্বল উদাহরণ।
ড. দণ্ডপাট বলেন, বর্ষার চরম আবহাওয়াজনিত যোগাযোগব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং রাজ্যের প্রথম ইন্টিগ্রেটেড চিপ উদ্ভাবন—এই দুটি সাফল্য শুধু এনআইটি মেঘালয়ের নয়, গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের গবেষণা ক্ষেত্রের পরিপক্বতার প্রতিফলন। তিনি জানান, গবেষকদল ইতিমধ্যে দ্বিতীয় একটি চিপের উন্নয়ন প্রকল্পেও হাত দিয়েছে, যা উৎপাদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। এই নতুন চিপটি বিভিন্ন পরিবেশগত উপাদান বিশ্লেষণ করে ফসলের বৃদ্ধি ও মাটির আর্দ্রতা পর্যবেক্ষণে আরও নির্ভুল তথ্য সরবরাহ করবে, যা কৃষিক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়নের নতুন পথ দেখাবে।
প্রযুক্তি, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও কৃষি—এই তিন ক্ষেত্রেই মেঘালয়ের এই যুগল সাফল্য উত্তর-পূর্ব ভারতের গবেষণা ও উদ্ভাবনের পরিকাঠামোয় নতুন দিশা খুলে দিয়েছে। এটি শুধু বৈজ্ঞানিক সাফল্য নয়, বরং বিকশিত ভারতের লক্ষ্যে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দৃঢ় পদক্ষেপের প্রতীক হয়ে উঠেছে।


