জয়ন্ত মণ্ডল
ভোটার শুধু ভোটার নন, তাঁরা সাধারণ মানুষ। আর সাধারণ মানুষ চাইলে ভোটারের পরিচয় সরিয়ে রেখে ক্ষমতাশালী শাসককে রাস্তায় টেনে নামিয়ে আনতে পারে এক ঝটকায়। যেখানে গণতন্ত্র, ভোটে নির্বাচিত সরকার, ইত্যাদির মতো ছেঁদো কথার কোনো দাম নেই। সেটাই দেখাল বাংলাদেশ। দেখল গোটা বিশ্ব।
বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশ জুড়ে চরম অস্থিরতা। সরকারি চাকরির কোটা পদ্ধতির সংস্কারের জন্য ছাত্রদের বিক্ষোভ হিসেবে যা শুরু হয়েছিল, সেটাই কয়েক দিনের ব্যবধানে রাস্তায় টেনে নামায় সর্বস্তরের মানুষকে। সমালোচনা, বিতর্ক যাই থাকুক না কেন, গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছিল সাধারণ মানুষের সেই বিক্ষোভ। যার জেরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শুধু পদত্যাগ করতেই হয়নি, দেশ ছাড়তেও বাধ্য করেছিল। বিস্তৃত ঘটনায় এই সংক্ষিপ্তসারের মর্মার্থ একটাই, শাসক যতই শক্তিশালী হন, ভোটের লড়াইয়ে যত বড় সাফল্যই অর্জন করুন, সম্মিলিত মানুষ চাইলে তাঁকে সিংহাসন থেকে টেনে নামানো শুধু মাত্র সময়ের অপেক্ষা!
বিশ্বের তথাকথিত গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দেশগুলির শাসকরা অবশ্য এত সহজে এ কথা মানতে নারাজ। তাঁদের কাছে ভোট মানে গণতন্ত্রের উৎসব। সেই উৎসবে এক বার জয়ী হতে পারলে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য খানিক নিশ্চিন্ত। মসনদ দখলের পর শাসন-অপশাসনের ফারাক ঘুচলেও ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার নিশ্চয়তা। ভোটারের মনে পুঞ্জীভূত হওয়া ক্ষোভ বিক্ষোভের কথা ভেবে দেখার তাগিদ থাকে না তখন। কিন্তু সেই ভোটাররা যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকতে ঠেকতে খাদের কিনারে দাঁড়ান, তখন একটা বাংলাদেশ ঘটে যায়। বহুবিধ কারণকে সামনে তুলে এনে বাংলাদেশের এই ঘটনাকে গণঅভ্যুত্থান মানতে নারাজ শাসক শিবির তাতে সন্তুষ্ট না হলেও মানুষের কিছু যায়-আসে না।
খোলা চোখে দেখা যাচ্ছে, মাসাধিক সময় ধরে চলা বাংলাদেশের ছাত্রদের এই আন্দোলন শুধু কোটা সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এটা হাসিনা ও তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন। যে কারণে সুপ্রিম কোর্ট কোটা নিয়ে আপাতত খুশি করার মতো রায় দিলেও হাসিনার পদত্যাগই মূল এবং একমাত্র দাবিতে রূপ নিয়েছিল। শুধু ছাত্র নয়, দেশের বড় অংশের মানুষকে পথে নামতে বাধ্য করেছিল। নইলে দেড় দশকেরও বেশি সময়ের হাসিনা সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব হয় কী করে? ক্যালেন্ডার বলছে, বিক্ষোভের প্রথম পর্যায় ছিল কোটা সংস্কার কেন্দ্রিক। দ্বিতীয়ার্ধে যা ব্যাপক আকার ধারণ করে। হাসিনা এবং তাঁর সরকারের দমন নীতিই প্রথম পর্যায় থেকে আন্দোলনকে দ্বিতীয় পর্যায়ে উত্তরণের পথ সুগম করে দিয়েছে। অর্থাৎ, ছাত্র থেকে সামগ্রিক জনগণকে আন্দোলনে নামিয়ে দেওয়ার বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়েছে ধাপে ধাপে। কিন্তু খুব দ্রুত। ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কেন্দ্রিক বিক্ষোভের দৃষ্টিভঙ্গি রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনের প্রতি সমর্থন বেড়ে যায়। তাতে অগুনতি মানুষ সমবেত হয়। সমাজের বিভিন্ন স্তরের নাগরিকদের অংশগ্রহণ সেটাকেই গণঅভ্যুত্থানের রূপ দেয়। যেটা নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেয়ে ভোটে জিতে আসা সরকারের ভাবনার বাইরে থেকে গেছে। সরকারি পুলিশ, গোয়েন্দাদের চোখ এড়িয়ে এটা কী করে হল?
"আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন এ বছরের ১১ জানুয়ারি। এর আগে ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদে নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। এরপর ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচন হয় একতরফা, যেখানে বিরোধী দলগুলো অংশ নেয়নি। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। এই নির্বাচন আগের রাতেই ব্যালটে সিল মারার ব্যাপক অভিযোগ ছিল। এ নির্বাচন ‘রাতের ভোট’ নামে পরিচিতি পায়। আর চলতি বছরের জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি আবার প্রধানমন্ত্রী হন। তবে এ নির্বাচনও বিতর্কিত। এতেও প্রধান বিরোধী দলগুলো অংশ নেয়নি। নিজদলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী করে ‘ডামি’ প্রতিদ্বন্দ্বিতার আয়োজন করা হয়। এ নির্বাচনটিকে বিরোধীরা ‘ডামি নির্বাচন’ বলে আখ্যা দেন। ছয় মাসের মাথায় ব্যাপক ছাত্র ও গণবিক্ষোভের মুখে তিনি পদত্যাগ করে হেলিকপ্টারযোগে দেশ ছাড়েন।"--- প্রথম আলো
ভোটে জিতে মনে হয়, শাসক অজেয়। এমন কেউ নেই, যে তাঁকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামাবে। কিন্তু বাংলাদেশ বা কিছুটা একই শ্রীলঙ্কার ঘটনা দেখিয়ে দিচ্ছে, ভোটের প্রতি আনুগত্যে অভাব দেখা দিতেই পারে। ইতিহাসেও যা নজিরবিহীন নয়। আসলে বিপুল ভোটে বারবার জিতে আসা ‘দাদা-দিদি’রা জনমনে প্রভাব ফেলা অনেক বিষয়কেই ধর্তব্যের মধ্যে আনেন না। পরবর্তীতে যা ক্রমশ একত্রিত হয়ে আগ্নেয়গিরির আকার নেয়। অনুকূল পরিস্থিতিতে শেষমেশ তার বিস্ফোরণ ঘটলে ২০২৪- এর বাংলাদেশ হয়ে যায়!
(লেখাটি সিন্ডিকেট থেকে নেওয়া, শিরোনাম ছাড়া সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত)