Home প্রবন্ধ স্বাধীনতা আন্দোলনের অলিখিত ইতিহাস: জালিয়ানওয়ালাবাগ ও উধম সিং

স্বাধীনতা আন্দোলনের অলিখিত ইতিহাস: জালিয়ানওয়ালাবাগ ও উধম সিং

সে দিন ব্রিটিশ শাসক অসংখ্য নিরপরাধ ভারতীয় নরনারীকে বুলেটের বন্যায় ধরাশায়ী করেই ক্ষান্ত হয়নি, শহরের গণ্যমান্য নাগরিকদের ঘর থেকে বাইরে টেনে টেনে এনে রাস্তায় হামাগুড়ি দিতে বাধ্য করেছিল। প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপথে ভারতীয়দের নাকে খত দিতে বাধ্য করেছিল ব্রিটিশ শাসক সে দিন।

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

১৯১৯ সাল। নববর্ষের দিন যেমন পয়লা বৈশাখের উৎসব বাংলায়, ঠিক তেমনই পঞ্জাবে উৎসবের দিন ‘বৈশাখী’।

শত সহস্র নরনারীর রক্তে সে দিন লাল হয়ে গিয়েছিল জালিয়ানওয়ালাবাগের পবিত্র মাটি। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে, বয়স্ক থেকে শুরু করে শিশু-কিশোর কেউই বাদ যায়নি। এমনকি সন্তানসম্ভবা নারীরাও সে দিন রেহাই পাননি পঞ্জাবের কুখ্যাত গভর্নর মাইকেল ও’ডায়ার এবং তাঁর উপযুক্ত সহচর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হ্যারি ডায়ারের পাশবিক অত্যাচার থেকে।

সে দিন ব্রিটিশ শাসক অসংখ্য নিরপরাধ ভারতীয় নরনারীকে বুলেটের বন্যায় ধরাশায়ী করেই ক্ষান্ত হয়নি, শহরের গণ্যমান্য নাগরিকদের ঘর থেকে বাইরে টেনে টেনে এনে রাস্তায় হামাগুড়ি দিতে বাধ্য করেছিল। প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপথে ভারতীয়দের নাকে খত দিতে বাধ্য করেছিল ব্রিটিশ শাসক সে দিন। নওজোয়ানদের সারাশরীরে চাবুক মেরে মেরে অজ্ঞান করা, মেয়েদের বেআব্রু করে তাদের গায়ে-মুখে থুথু দেওয়া – সভ্যতার মুখোশ পরা সেই নরপশুগুলো সে দিন কী করেনি!

সেই সব ঘটনা শুনে সারাদেশে বিক্ষোভে মানুষ ফেটে পড়েছিল। রবীন্দ্রনাথ এক লহমায় ব্রিটিশ রাজশক্তির প্রদেয় ‘নাইট’ উপাধি প্রত্যাখ্যান করে তৎকালীন বড়োলাট লর্ড চেমসফোর্ডকে লিখলেন: “অমানুষ বর্বরের মতো যারা আমার দেশের অসহায় নরনারীকে এইভাবে হত্যা করতে পারে, মানবসভ্যতার কলঙ্ক তারা, মানবতার শত্রু তারা, তাদের দেওয়া নাইট উপাধির সম্মান আমি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি।”

এখানে উল্লেখ্য জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের ১০০ বছর পরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন সে দিনের সেই অমানবিক ঘটনার জন্য ক্ষমা চান এবং সেই সময়ের ব্রিটিশ প্রশাসকদেরও কঠোর সমালোচনা করেন।

কিন্তু ১৯১৯ সালে পঞ্জাবের ওই ঘটনায় ব্রিটিশ হাউস অফ লর্ডস ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ারকে, আর গভর্নর মি. ডায়ারকে অভিনন্দন জানিয়েছিল। বিলেতের অভিজাত সম্প্রদায় শুধু অভিনন্দন নয়, অর্থ দিয়ে পুরস্কারে ভূষিত করেছিল সেই নরাধমদের।

অসংখ্য ক্ষুব্ধ ভারতবাসীর মতো সে-ও শুনত জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনাগুলি একের পর এক। কতই বা বয়স তখন তার? ১৮৯৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর পঞ্জাবের সুনামে (লাহোর থেকে ১৩০ মাইল দক্ষিণে) তার জন্ম, আর জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনা ১৯১৯ সালের। তা হলে আমাদের এই উপাখ্যানের ছেলেটি তখন ১৯/২০ বছরের তরতাজা নওজোয়ান। সর্দার তেহাল সিং আর নারাইন কৌরের পুত্র আমাদের আলোচ্য ছেলেটির নাম উধম সিং, জন্মের পর যার নাম রাখা হয়েছিল শের সিং। সে দিন এক বিচিত্র বিক্ষুব্ধ চেতনায় সে সবার অজান্তে মনে মনে শপথ নিয়েছিল – যারা আমার দেশের শত শত অসহায় মানুষকে অকারণে এই ভাবে খুন করেছে, একদিন তাদের আমি নিজের হাতে উচিত শিক্ষা দেবই। তাদের রক্ত নিয়ে খেলব হোলি। বন্দেমাতরম।

তার পর কেটে গেল দীর্ঘ একুশটা বছর। উধম সিং কিন্তু প্রতিজ্ঞায় স্থির। যদিও ইতিমধ্যে ব্রিগেডিয়ার হ্যারি ডায়ার মহাকালের নির্দেশে পরপারে চলে গিয়েছেন। রয়েছেন কুখ্যাত গভর্নর মি. ও’ডায়ার।

উধম সিং পঞ্জাবে পড়াশোনা করতে করতেই প্রথমে গদর পার্টির সংস্পর্শে আসেন, তার পর হিন্দুস্থান সোস্যালিস্ট রিপাবলিক অ্যাসোসিয়েশন এবং ভারতীয় শ্রমিক সমিতির সঙ্গে যুক্ত হন। বুকের মধ্যে দেশমাতৃকার জন্য কিছু একটা করার তাগিদ কুরেকুরে খাচ্ছে তখন তাঁকে। মনে পড়ে যায় তার শপথের কথা। জালিয়ানওয়ালাবাগের প্রতিশোধ-এর কথা।

কিন্তু মাইকেল ও’ডায়ার কোথায়? জানা গেল তিনি তখন চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বিলেতে বহাল তবিয়তে বিরাজ করছেন। উধম সিং প্রস্তুতি নিতে শুরু করল বিলেতে যাওয়ার জন্য। মনে মনে বললেন, সেই শয়তানকে আমার চাই-ই চাই। যেখানেই থাকুক সে। তার সাথে হিসেবনিকেশ আমি করবই।

উধম সিং চলে গেলেন ইংল্যান্ডে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। এ বার অপেক্ষা একটা সুযোগের। ভেতরে ভেতরে ছটফট করছেন উধম সিং। টগবগিয়ে উঠছে তাঁর সারা শরীরের রক্তকণা। অবশেষে এল সেই সুযোগ।

১৯৪০ সালের ১৩ মার্চ। ব্রিটেনের ক্যাক্সটন হলের টিউডর রুমে সে দিন প্রচণ্ড ভিড়। রয়্যাল এশিয়ান সোসাইটি এবং ইস্ট ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের যৌথ উদ্যোগে এক আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়েছে। আলোচনার বিষয়বস্তু: ‘আফগানিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি’। সভার সভাপতি লর্ড জেটল্যান্ড। আসতে পারেন মাইকেল ও’ডায়ার, খবর আছে। কথাটা উধম সিংয়ের কানে গেল। তিনিও প্রস্তুতি নিতে লাগলেন।

নির্দিষ্ট দিনের সেই সভায় তিলধারণের জায়গা নেই। নিমন্ত্রিত অতিথিরা সবাই এসে গিয়েছেন।উধম সিং-ও নিমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে একজন। কিন্তু ডায়ার কই? উধম সিংয়ের চোখ এদিক-ওদিক খুঁজে যাচ্ছে।

বেলা তখন প্রায় তিনটে। সভায় কে ঢুকলেন? উধম সিংয়ের চোখদুটো চকচক করে উঠল। কে? কে? কে এই লোকটা? মাইকেল ও’ডায়ার না? হ্যাঁ, হ্যাঁ তা-ই তো। বাঃ! খুব কাছে পেয়ে গিয়েছেন শিকারকে। উত্তেজনায় সারাটা শরীর  তিরতির করছে উধমের। নিজেকে শান্ত করলেন উধম ধীরে ধীরে।

সময় কেটে গেল। সভা শেষ। সবাই বিদায় নিতে তৈরি হচ্ছেন। উধম সিং পকেটে হাত দিয়ে পজিশন নিয়ে নিলেন। ওই তো মাইকেল ও’ডায়ার আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছেন, আসছেন, আসছেন…।

সহসা উধমের রক্তে আগ্নেয়গিরির আগুন ঝলসে উঠল – পেয়েছি। আজ পেয়েছি শয়তান তোমাকে। ভারতীয়রা তার জাতের অপমানের, হত্যার প্রতিশোধ নিতে জানে – উধম বদ্ধপরিকর তার প্রতিজ্ঞাপালনে।

udham singh 12.08

চোখের পলকে উধম সিং-এর রিভলবার আগুনমুখো হয়ে উঠল – দ্রাম্, দ্রাম্, দ্রাম্…। কুখ্যাত গভর্নর মাইকেল ও’ডায়ার খতম। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রায় ২১ বছর পরে।

শুরু হল হইচই। পালাও পালাও পালাও সব। চারিদিকে চিৎকার-চেঁচামেচি। কিন্তু উধম সিং নির্বিকার। ধীরস্থির ভাবেই আত্মসমর্পণ করলেন সে দিন পুলিশের কাছে। জীবনের একমাত্র স্বপ্ন, সাধ তাঁর আজ পূর্ণ হয়েছে, সফল হয়েছে। আজ তিনি সুখী, সার্থক, বিজয়ী।

ভারতে যখন খবর এল, সারাদেশ আনন্দে বিহ্বলিত। উধম সিং, তোমার তুলনা নেই। আমরা ভুলেই গেছিলাম প্রায় সেই ঘটনা, কিন্তু তুমি? তুমি সেই দিনটার কথা ভোলোনি। মনে রেখেছিলে, প্রতিশোধ নিলে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের।

পরের দিন উধম সিং-কে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে তোলা হল।

“কি নাম তোমার?” উধম সিং চুপচাপ।

“কাগজপত্র থেকে তো জানা যাচ্ছে, তোমার নাম রাম মহম্মদ সিং আজাদ? পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। তা-ই কি?”

নিরুত্তর উধম সিং। অবশেষে গোয়েন্দাগিরি করে শুরু হল তদন্ত। কে এই রাম মহম্মদ সিং আজাদ? আসল না নকল পরিচয়?

২১ এপ্রিল, ১৯৪০। বো স্ট্রিটে পুলিশ কোর্টে আনা হল উধম সিং-কে, আর তাঁর বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃত নরহত্যার অভিযোগ আনা হল।

হায়রে কী সভ্য জাত এই ইংরেজ! ২০ বছর আগে যে শয়তানের পরিকল্পনামতো শতশত নিরীহ মানুষ খুন হয়েছিল, আজ ২০ বছর পরে সেই নরাধমকে স্বজাতির হত্যার প্রতিশোধ নিতে হত্যা করায়, উধম সিং শাস্তির চার্জ দেওয়া হচ্ছে, সে নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষ খুন করেছে? ধুর! এই শয়তান ব্রিটিশ শাসক বা স্বৈরাচারী শাসকরা কি মানুষ হয় নাকি? এরা তো মানুষের রক্ত খায়।এরা কি মানুষ?

সে দিন পুলিশের জেলে, কোর্টের অনেক অফিসার উধম সিংয়ের এই কাজকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত ওল্ড বেইলি সেন্ট্রাল কোর্ট রায় দিয়েছিল – প্রাণদণ্ড।

আদেশ শুনে এতটুকুও মাথা নোয়ালেন না বীর বিপ্লবী উধম সিং। কোনোরকম ক্ষমা ভিক্ষা নয়। মনে মনে হয়তো বলেছিলেন সে দিন – ‘ওগো আমার মাতৃভূমি, ওগো আমার জন্মভূমি, আমার দেশমাতৃকা, আমার কাজ শেষ, এবার আমার ছুটি। আমার বিদায় নেওয়ার পালা।

১৯৪০ সালের ১ জুন পেন্টনভেলি জেলের ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে উচ্চারণ উধম বলেছিলেন: আমার প্রতিজ্ঞা আমি রক্ষা করেছি। এজন্য আমি গর্বিত। বন্দেমাতরম। বন্দেমাতরম।

ফাঁসির দড়ি পরে নিলেন গলায়। যেন পরে নিলেন দেশমাতৃকার বরণমালাখানি। নিজের শপথ রক্ষা করে চিরবিদায় নিলেন দেশমাতৃকার অমর বীর বিপ্লবী সন্তান উধম সিং।

শ্রদ্ধায় মাথা নোয়ালেন সারা পঞ্চনদের তীরের পঞ্জাব প্রদেশ। অবিভক্ত বাংলা। অখণ্ড ভারতবর্ষ। সমগ্র মানবতা, মানব সভ্যতা। মাথা নত করে বিনম্র শ্রদ্ধা জানালেন কোটি কোটি নির্যাতত, নিপীড়িত মানুষ।

ধন্য উধম সিং। তুমি ধন্য।তুমি অনন্য। তোমাকে ভুলি এমন সাধ্য কই? তুমি আমাদের স্মরণে, বরণে চিরকাল চিরঅম্লান হয়েই থাকবে আমাদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের পাতায়।

আরও পড়ুন

স্বাধীনতা আন্দোলনের অলিখিত ইতিহাস: সত্যবতীর কথা

স্বাধীনতা আন্দোলনের অলিখিত ইতিহাস: জালালাবাদে আত্মবলিদান

স্বাধীনতা আন্দোলনের অলিখিত ইতিহাস: মদনলাল ধিংড়ার আত্মবলিদান 

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version