পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
একটা সুবৃহৎ দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস এত পক্ষপাতিত্ব করে লেখা হয়েছে, যার উদাহরণ পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। শুধু আমাদের দেশেই আছে। লেখা হয়েছে শুধু যেন গান্ধী, নেহরু, পটেল, রাজাজি আর কংগ্রেস দলটাই স্বাধীনতা এনেছে, আর বাকি অলিখিত অব্যক্ত ইতিহাসের যেন কোনও প্রভাব পড়েনি আমাদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে। যদিও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বাংলা, পঞ্জাব-সহ বিভিন্ন জায়গার বিপ্লবীদের আন্দোলন এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ বাহিনীর লাগাতার ব্রিটিশবিরোধী লড়াইয়ের ফলেই ব্রিটিশরা আমাদের দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিল। সেই প্রামান্য ইতিহাস আছে। অন্য কোনো পরিসরে তা আলোচিত হবে। কিন্তু এটা চিরকালীন সত্য যে, স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্রতী সেই সব দেশপ্রেমিকের প্রত্যাশাহীনভাবে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করার ইতিহাস বা ঘটনা ব্রিটিশ শাসকের মসনদ নাড়িয়ে দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের কথায় – ‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন’ এবং ‘পড়ি গেল কাড়াকাড়ি,/ আগে কেবা প্রাণ করিবেক দান/ তারি লাগি তাড়াতাড়ি’।
তাই তো অমর হয়ে আছে বাঁকুড়ার লোককবি পীতাম্বর দাস বাউলের সেই গান, যা শহিদ ক্ষুদিরামদের প্রতি উৎসর্গ করা – ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি…’। ১৮ বছরের এক কিশোরের ফাঁসির মঞ্চে আত্মবলিদান থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে সে দিন বাংলার ঘরে ঘরে জন্ম নিয়েছিল বীর বিপ্লবী সন্তানরা। ক্ষুদিরাম বসু নিজের ফাঁসির দিনক্ষণ জানার পরেও মুজফফরপুর কারাগারে বসে লিখেছিলেন শেষ চিঠি মায়ের মতো বড়দিদিকে। ভাবা যায়? সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করেই নিশ্চিত মরণের মুখে দাঁড়িয়েও আরও কত শহিদ সন্তান কী অকুতোভয় বলিষ্ঠতায়, বুকের পাটায় তাঁদের কথা চিঠিতে লিখে গিয়েছেন, আমরা কি তার কোনো খবর রাখি? স্বাধীনতা ভিক্ষে করে আসে না। হাত কচলিয়ে অনুনয়-বিনয় করেও স্বাধীনতা পাওয়া যায় না। স্বাধীনতা কেড়ে নিতে হয়। রক্ত দিয়ে, মৃত্যু দিয়ে, লড়াইয়ের মধ্যে দিয়েই স্বাধীনতা আসে। তাই অগ্নিশুদ্ধ আমাদের জন্মভূমির সেই অজ্ঞাত ইতিহাসই আজ আমাদের মুখোমুখি।

ফাঁসির মঞ্চে যাঁরা জীবনের জয়গান গেয়ে গেলেন – রামকৃষ্ণ রায়, ব্রজকিশোর চক্রবর্তী এবং নির্মলজীবন ঘোষ।
মেদিনীপুরের এক দামাল ছেলে ব্রজকিশোর চক্রবর্তী (জন্ম মেদিনীপুরের বল্লভপুর গ্রামে ১৯১৩ সালে। বাবা উপেন্দ্রকিশোর চক্রবর্তী, মানিস্তারিনী দেবী। ফাঁসি ২৫ অক্টোবর ১৯৩৪)। মা-বাবা আদর করে ডাকতেন ‘বেজা’ বা ‘বুজু’ বলে। তৎকালীন মেদিনীপুর জেলার অত্যাচারী পাষণ্ড জেলাশাসক মি. বার্জকে পরপারে পাঠানোর দায়িত্ব নিলেন ব্রজকিশোররা। যেমন ভাবা তেমনই কাজ। তবে সাথে দায়িত্ব নিলেন আরও দুই বিপ্লবী বন্ধু রামকৃষ্ণ রায় (জন্ম মেদিনীপুরের চিরিমাতসাই গ্রামে, ৯ অক্টোবর ১৯১২। বাবা কেনারাম রায়, মা ভবতারিণী দেবী। ফাঁসি ২৫ অক্টোবর ১৯৩৪ সাল) এবং নির্মলজীবন ঘোষ (জন্ম হুগলির ধানসিল গ্রামে ৫ জানুয়ারি ১৯১৬। বাবা যামিনীজীবন ঘোষ, মা অভয়ারানী দেবী। ফাঁসি ২৫ অক্টোবর ১৯৩৪)। পরিকল্পনা হল অপেক্ষায় থাকার দলে রয়েছেন আরও বেশ কয়েক জন বিপ্লবী। শয়তান মি. বার্জকে যথোপযুক্ত শাস্তি তথা মৃত্যু দিতেই হবে। এই বিপ্লবীরা সেই শাস্তি দিয়েওছিলেন। শাস্তি দেওয়ার মুহূর্তেই দু’জন শহিদ হন। অনাথ (অনাথবন্ধু পাঁজা) ও মৃগেন (মৃগেন্দ্রনাথ দত্ত)। পরে ধরা পড়ে বাকিরা। তাঁদের মধ্যে ব্রজ, রামকৃষ্ণ, নিমলের ফাঁসি হয়েছিল একই দিনে – ১৯৩৪ সালের ২৫ অক্টোবর।
ফাঁসির ৪/৫ দিন আগে ব্রজ তাঁর বাবাকে চিঠি লিখছেন মৃত্যুভয়কে তাচ্ছিল্য করে – “বাবা, আপনি চার বছর আগে বলেছিলেন যে, যখন আমার চন্দ্রের দশা পড়বে তখন আমাকে বারো বছর প্রবাসে বাস করতে হবে। এমনকি আমার মৃত্যু হওয়াও অসম্ভব নয়। এই কথা আজ বর্ণে বর্ণে সত্য হচ্ছে…”। ব্রজকিশোর তাঁর মা-কে যে চিঠি লিখেছিলেন, তাতে মায়ের আদরের ‘বেজা’, ‘বুজু’ নামগুলি উল্লেখ করেন –“আমার মা, মা আমার, প্রণাম নিন।…ভোরের বেলা শূন্যকোলে/ ডাকবে যখন ‘বেজা’ বলে/ বলবো আমি – নাই গো ‘বেজা’ নাই,/ মাগো, এবার আমি তবে যাই…।” (অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তাঁর লেখা। এখানেও রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতায় নিজের নাম যুক্ত করে তিনি ওই কবিতাটি লিখেছিলেন মা-কে।)
১৯৩৪ সালের ২৫ অক্টোবরেই মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে ব্রজকিশোরের সঙ্গেই ফাঁসি হয়েছিল আর-এক অগ্নিসন্তান রামকৃষ্ণ রায়ের। ফাঁসির আগে তিনিও তাঁর মা-কে চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠির প্রতিটি ছত্রে ছত্রে মরণকে হাসিমুখে বরণ করে নেওয়ার এক অনির্বচনীয় আনন্দ ঝরে পড়েছে। মৃত্যুকে তাঁর মনে হয়েছিল যেন আলোর দ্যুতি, আর সেই আলোয় নয়নধোয়া বিমুগ্ধতায় তিনি ছুটে চলেছেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে অনন্তের বুকে মিশে যাওয়ার রোমাঞ্চতায়। সেখানে কোনো ভয় নেই, কোনো আক্ষেপ নেই – শুধু আনন্দ, আনন্দ আর আনন্দ। যদিও দেশমাতৃকার চোখে জল, জন্মদায়িনীর চোখে নীরব অশ্রুর বন্যা, রামকৃষ্ণ রায় কিন্তু লিখছেন – “মাগো, আজ আমার হৃদয়ে কী সুখ যে অনুভব করছি, তা আমি নিজেই বুঝতে পারছি না।…আমি তবে এবারের মতো আসি মা!! তোমার কোল হতে চিরবিদায় নিয়ে চললাম, মা। সঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের ছবিটি, কবিগুরুর বইখানি আর গীতাটি রয়েছে। সেগুলি তোমার কাছে পাঠানোর জন্যে রেখে গেলাম,…কাঁদবে না একদম। আমার মায়ের আর আমার মাতৃভূমির শিকল ছিন্ন করার মন্ত্র নিয়ে আমি আবার আসব ফিরে তোমারই কোলে মা – দুঃখ কোরো না – এবার তবে আমি যাই? এবার তবে আসি মা!…।”
ব্রিটিশ শাসকের হাতে যাঁরা ধরা দিলেন না – অনাথবন্ধু পাঁজা ও মৃগেন্দ্রনাথ দত্ত।
নির্মল মা-কে চিঠিতে লিখছেন – “মাগো, তুমি কি ভাবছো, আমি একেবারেই চলে যাচ্ছি? নাগো না, আমি সারাক্ষণই তোমার কাছেই থাকবো। যখনই তোমার মন কেমন করবে, আমাকে মনে মনে ডেকে নিও আমায়, আমি ছুটে চলে আসব গো তোমারই কাছে।”
মেদিনীপুর জেলা ছিল সেই সময়ের স্বদেশি বিপ্লবীদের ঘাঁটি। সেখানকার জেলা শাসক মি. বার্নাড ইজে বার্জ ছিলেন এক সাক্ষাৎ শয়তান। বাঙলার বিপ্লবীদের জাতক্রোধ ছিল এই শয়তানের ওপরে। সুযোগের অপেক্ষায় ছিল বিপ্লবীরা। সেই সুযোগ এল ১৯৩৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর। বিকেল বেলা। মেদিনীপুর কলেজ মাঠে মহমেডান স্পোর্টিং দলের সঙ্গে ব্রিটিশদের মেদিনীপুর ক্লাবের ফুটবল খেলা। অনেক খেলোয়াড় সেখানে জড়ো হয়েছেন। মি. বার্জও উপস্থিত সেখানে। সেই ফুটবল মাঠেই খেলাচ্ছলে নামেন অনাথবন্ধু পাঁজা (২৯.১০.১৯১১ – ০২.০৯.১৯৩৩), মৃগেন্দ্রনাথ দত্ত (২৭.১০.১৯১৫ – ০২.০৯.১৯৩৩), ব্রজকিশোর চক্রবর্তী, রামকৃষ্ণ রায় এবং নির্মলজীবন ঘোষ। ফুটবল নিয়ে এদিক-ওদিক করতে করতে একদম জেলাশাসকের কাছে গিয়েই দ্রাম, দ্রাম, দ্রাম। শয়তান বার্জ শেষ। আহত হলেন জোন্স। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের পাল্টা গুলি। মাঠেই শহিদ হলেন অনাথবন্ধু এবং মৃগেন্দ্রনাথ। পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন ব্রজ, নির্মল রামকৃষ্ণ, নন্দদুলাল সিং, কামাখ্যা ঘোষ, সুকুমার সেন, সনাতন রায় প্রমুখ।
পরে সকলেই গ্রেফতার হন। একবছর ধরে চলে ট্রাইবুনাল কোর্ট-এ বিচার। অবশেষে ব্রজকিশোর, রামকৃষ্ণ, নির্মলের ফাঁসি হয়। আর বাকিদের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর।
ভাবলে অবাক লাগে, আমাদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের পাতায় অলিখিত অধ্যায় হয়েই রয়ে গেলেন ভারতমায়ের তথা বাংলামায়ের এই বীর বিপ্লবী সন্তানেরা, চিরউপেক্ষিত হয়ে।
তথ্যঋণ:
১। জেলে ত্রিশ বছর ও পাক-ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম – ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী।
২। আমি সুভাষ বলছি – শৈলেশ দে।
৩। বিপ্লব ও বিপ্লবী – অমলেন্দু ঘোষ।
আরও পড়ুন
স্বাধীনতা আন্দোলনের অলিখিত ইতিহাস: সত্যবতীর কথা
স্বাধীনতা আন্দোলনের অলিখিত ইতিহাস: জালালাবাদে আত্মবলিদান
স্বাধীনতা আন্দোলনের অলিখিত ইতিহাস: মদনলাল ধিংড়ার আত্মবলিদান
স্বাধীনতা আন্দোলনের অলিখিত ইতিহাস: জালিয়ানওয়ালাবাগ ও উধম সিং