Home প্রবন্ধ ফেসবুক না কি ফেকবুক? ভাইরালে আচ্ছন্নতা এড়াতে সতর্কতাই একমাত্র অস্ত্র

ফেসবুক না কি ফেকবুক? ভাইরালে আচ্ছন্নতা এড়াতে সতর্কতাই একমাত্র অস্ত্র

0

আজকের ডিজিটাল যুগে, ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলি আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। প্রাথমিকভাবে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে জনপ্রিয় হলেও, ফেসবুক আজ এক বিপজ্জনক প্ল্যাটফর্মের আকার নিচ্ছে, যা সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিভ্রান্তি, বিদ্বেষ ছড়াতে সক্ষম। মত প্রকাশের অধিকারকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, এটি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে এবং সামাজিক বিভাজন তৈরি করছে, তা সমাজের স্থিতিশীলতার ওপর এক গভীর প্রভাব ফেলছে।

মত প্রকাশের অধিকারের অপব্যবহার

ফেসবুক নিজেকে সবসময় একটি উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্ম হিসেবে তুলে ধরে, যেখানে প্রতিটি ব্যক্তি নিজের মত প্রকাশের অধিকার প্রয়োগ করতে পারে। গণতন্ত্রের একটি মূল নীতি হল মত প্রকাশের স্বাধীনতা, যা একদিকে ব্যক্তি বিশেষের অধিকারকে সম্মান করে, অন্যদিকে সমাজে ইতিবাচক আলোচনা ও পরিবর্তনের জায়গা তৈরি করে। তবে, ফেসবুকের মাধ্যমে এই অধিকার আজ অপব্যবহৃত হচ্ছে।

প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলেন, ফেসবুকের অ্যালগরিদম এমনভাবে কাজ করে যে, যেকোনো উগ্র বা বিভাজনমূলক পোস্ট দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। মত প্রকাশের অধিকারকে সুরক্ষার অজুহাতে অনেক সময় এমন কনটেন্ট ছড়ানো হয় যা বিদ্বেষ, ঘৃণা এবং ভুল তথ্যকে বাড়িয়ে তোলে। ফলে সমাজে বিভ্রান্তি এবং বিভাজন তৈরি হচ্ছে। আজকের সময়ে ফেসবুক শুধু মত প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম নয়, বরং এক ধরনের প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভুল তথ্য ও দ্রুত প্রচার

ফেসবুকের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত মিথ্যা তথ্য এবং প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে। ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রবণতা একটি বিশেষ সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে, যা সমাজের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর প্রভাব ফেলছে। মিথ্যা তথ্য শুধুমাত্র মানুষকে বিভ্রান্ত করে না, বরং তারা যে রাজনৈতিক মতামত তৈরি করে, তা প্রায়শই ভিত্তিহীন এবং বিভ্রান্তিকর হয়ে ওঠে।

একাংশের মতে, ফেসবুকের মাধ্যমে ছড়ানো মিথ্যা তথ্য এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ওপর আঘাত আনছে। মানুষ ভুল তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, যা নির্বাচনের ফলাফলের ওপর প্রভাব ফেলছে। ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফেসবুকের মাধ্যমে মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর প্রভাব সুস্পষ্টভাবে দেখা গিয়েছিল। এতে প্রমাণ হয়েছিল, কীভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলি একটি জাতির গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বিকৃত করতে পারে। অতিসম্প্রতি, বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়ে গেল, তার নেপথ্যেও বড় ভূমিকা রয়েছে ফেসবুকের। কয়েক মাস আগে নির্বাচনে জিতে আসা সরকারকে উপড়ে ফেলে দিয়েছে জনরোষ। কারণ রয়েছে বহুবিধ। তবে সব পরিস্থিতিকেই সময় মতো ব্যবহারে অনেকটাই সহায়ক হয়ে উঠেছিল ফেসবুক প্রচার।

সামাজিক বিভাজন এবং বিদ্বেষের উত্থান

ফেসবুকের আরেকটি বড় সমস্যা হল এটি সামাজিক বিভাজনকে বাড়িয়ে তোলে। ফেসবুকের অ্যালগরিদম এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, ব্যবহারকারীরা তাদের মতের সঙ্গে মিল থাকা কনটেন্ট বেশি দেখতে পায়। এই ‘ইকো চেম্বার’ প্রভাবের কারণে মানুষ আরও বেশি উগ্র এবং চরমপন্থী মতামত গ্রহণ করে। ফলে সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্বেষ বাড়ে।

ধর্ম, রাজনীতি, জাতিগত পরিচয়—এই সমস্ত বিষয় নিয়ে ফেসবুক প্ল্যাটফর্মে প্রচুর বিতর্ক এবং সংঘাত দেখা যায়। অনেক সময় এই ধরনের বিতর্কগুলি হিংসার পর্যায়ে পৌঁছায়। অনেক দেশেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং হিংসাত্মক ঘটনার পিছনে ফেসবুকের প্রভাব বেশ কয়েকবার লক্ষ্য করা গেছে। এই প্ল্যাটফর্ম শুধুমাত্র মত প্রকাশের মাধ্যম হয়ে থাকেনি, বরং বিভাজনমূলক এবং উগ্র রাজনীতির ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।

তথ্যের অপব্যবহার

ফেসবুকের আরেকটি গুরুতর সমস্যা হল ব্যক্তিগত তথ্যের অপব্যবহার। ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ এবং তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে শেয়ার করার অভিযোগ বারবার উঠেছে। এই তথ্য ব্যবহার করে রাজনৈতিক দলগুলি এবং কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলি ব্যক্তিগত প্রভাব বিস্তার করে থাকে। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারি ফেসবুকের তথ্যের গোপনীয়তা নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলে ধরেছিল, যেখানে কোটি কোটি ব্যবহারকারীর তথ্য রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল।

এখন কী হবে?

ফেসবুকের এই প্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সমাজকে এখনই সচেতন হতে হবে। প্রথমত, মানুষকে বুঝতে হবে যে, ফেসবুক শুধুমাত্র একটি মত প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম নয়, বরং এটি একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, যার মূল উদ্দেশ্য লাভ করা। ফলে, এর অ্যালগরিদম সবসময় আমাদের সর্বোচ্চ সুবিধা দেওয়ার জন্য নয়, বরং আমাদের মনোযোগ ধরে রাখার জন্য কাজ করে।

দ্বিতীয়ত, ফেসবুকের নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বিভিন্ন মহল থেকে বারবার উঠে এসেছে। ভুল তথ্য ছড়ানোর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ এবং বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। বিভিন্ন সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাকে এই বিষয়ে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

ফেসবুকের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল মানুষকে একত্রিত করা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে প্রসারিত করা। কিন্তু আজকের দিনে ফেসবুক সমাজের নতুন বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা গণতন্ত্রের ভিত্তিকে দুর্বল করছে। মিথ্যা তথ্য, বিভাজন, এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অপব্যবহার সমাজের শান্তি এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ওপর আঘাত হানছে। এখনই দরকার এই প্ল্যাটফর্ম নিয়ে মানুষের সচেতন হওয়া। শুধুমাত্র আবেগ অথবা উত্তেজনার বশে নয়। সঠিক তথ্য যাচাই করেই কোনো বিষয়ে নিজের মতামত প্রকাশ করা উচিত।

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version