শ্রয়ণ সেন
“আচ্ছা আমরাও কি এই নাসিকে একটা প্রতীকী রাতদখল করতে পারি না?”
গ্রুপ সদস্যদের প্রস্তাবটা দিতেই সবাই এককথায় রাজি হয়ে গেলেন। কলকাতা তথা গোটা পশ্চিমবঙ্গে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, তার আঁচ সুদূর মহারাষ্ট্রে আমাদের ওপরেও এসে পড়েছে।
৮ আগস্টের মধ্যরাতে আরজি কর হাসপাতালে কী হয়েছে আর তার প্রেক্ষিতে কী কী ঘটে চলেছে, পুরোটার সঙ্গে ওয়াকিবহাল আমরা। ১৪ আগস্টের রাতে রাতদখলের যে পরিকল্পনা গোটা কলকাতা জুড়ে হচ্ছে, আমরাও তাতে প্রভাবিত হয়ে পড়েছি।
এল সেই রাত। বাকি দেশ যখন মধ্যরাতে স্বাধীনতা উদযাপনে মেতেছে, তখন কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গা গর্জে উঠছে আরজি কর হাসপাতালের ঘটনার বিরুদ্ধে। নাসিকে সেই প্রতীকী রাতদখল করলাম আমরা সবাই। বিচার চাইয়ের স্লোগানে মুখরিত হল মহারাষ্ট্র পর্যটনের হোটেলচত্বর।
মহারাষ্ট্র সফর শেষে কলকাতায় যখন ফিরলাম, শহরটাকে অন্যরকম লাগছিল। শহরের মুডই বদলে গিয়েছে। নাগরিক সমাজের পাশাপাশি খেলাধুলোর জগতেও অভয়াকাণ্ডের আঁচ এসে পড়েছে। সেই দিনই শহরের তিন ফুটবল প্রধান তথা ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান এবং মহামেডানের সমর্থকরা পথে নেমেছে প্রতিবাদ জানাতে। যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের সামনে সেই প্রতিবাদে শামিল হয়ে পুলিশি ধরপাকড়ে পড়েছেন তাঁরা। খেলার মাঠে যে মানুষগুলো একে অপরের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী, চিরশত্রু, তাঁরাই এ দিন এক হয়ে পথে নেমেছেন। বার বার গলা মিলিয়েছেন সেই একই স্বরে, “অভয়ার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই!”
আগেও বলেছি, অভয়াকাণ্ডের ভয়াবহতা, সব ভয়াবহতাকে ছাপিয়ে গিয়েছে। আর ঠিক সেই কারণে এটা সবাইকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে। এটা ঠিক যে ধর্ষণ করে খুনের মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা ভারতে আগে হয়েছে। আমরা নির্ভয়াকাণ্ড দেখেছি, হাতরাসকাণ্ড দেখেছি, উন্নাওকাণ্ড দেখেছি, তেলঙ্গানার সেই ঘটনাটি দেখেছি। কিন্তু অভয়াকাণ্ডের প্রেক্ষিত ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। এই লড়াই ছিল পচন ধরা একটা গোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। হাসপাতালের হুমকি-সংস্কৃতি যা এই ব্যবস্থারই একটা অংশ।

ঘটনায় রাগ, দুঃখ হয়েছে। কিন্তু পাশাপাশি বাঙালি হিসেবে গর্ব হয়েছে। কারণ কলকাতার মানুষ তথা বাঙালিই পেরেছে একটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে এই ভাবে গণআন্দোলন সংগঠিত করতে। ২০১২ সালের নির্ভয়াকাণ্ডের পর এই ধরনের গণবিক্ষোভ আর কোনো ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। তা-ও নির্ভয়াকাণ্ডের গণবিক্ষোভের স্থায়িত্ব ছিল কয়েক মাস। উন্নাওকাণ্ডেও এমন প্রতিবাদ হয়নি, যেখানে এক বিধায়কের সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
অন্য দিকে, এক বছর পেরিয়ে গেলেও অভয়াকাণ্ড কিন্তু এখনও জ্বলন্ত একটা ইস্যু। শুক্রবারের রাত বুঝিয়ে দিয়েছে বাঙালি এই ঘটনাকে ভুলে যায়নি। প্রতিবাদ দেখানোর সুযোগ এলেই বাঙালি পথে নামছে।
কথায় বলে ভয় জিনিসটা সংক্রামক। কিন্তু বাঙালির এই গণজাগরণে কিন্তু সাহসও সংক্রামক হয়ে উঠেছে। গত বছর ১৪ আগস্টের রাতদখল করার একটা ছোট্ট আহ্বান যে ভাবে স্ফুলিঙ্গের মতো বেড়ে উঠল, তার থেকে প্রমাণ হয় যে দীর্ঘদিন ধরে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ এবার বেরোতে শুরু করেছে।
গণজাগরণ কোন পর্যায়ে যেতে পারে সেটা দ্রোহের কার্নিভালেই আমরা দেখেছিলাম। কলকাতার লক্ষ লক্ষ প্রতিবাদী মানুষ সে দিন জড়ো হয়েছিলেন ধর্মতলায় জুনিয়র ডাক্তারদের অনশনমঞ্চের কাছে।
গত বছরের দুর্গাপুজোটা কিন্তু ওই অনশনমঞ্চকেন্দ্রিকই কেটেছিল আমাদের অনেকের। এই অনশনে যারা বসেছিল সবাই আমার বন্ধুসম। আমার থেকে ছোটোও হতে পারে। তারা যেখানে একটা গোটা ব্যবস্থার পরিবর্তনের ডাক দিয়ে এক অসম লড়াইয়ে নেমেছে, না খেয়ে থাকার পণ নিয়েছে। সেখানে আমার পক্ষে উৎসবে থাকা তো সম্ভব হত না।
ভুল বললাম, উৎসবেই তো ছিলাম। এটা যে বিদ্রোহের উৎসব। সবাই উজ্জীবিত। গানে-স্লোগানে-প্রতিবাদে মুখরিত পুজোর কলকাতা। ‘উই ডিমান্ড জাস্টিস’-এর মতো পরিচিত স্লোগান দেওয়া শুরু হল। একটু একটু করে স্লোগান থেকে শুরু করে তাতেও নানা রকম অভিনবত্ব এল। আমিও সেই স্লোগানে গলা মেলাতে শুরু করলাম।
ধর্মতলার ওই অনশনমঞ্চে প্রতিবাদের ঝাঁঝ দিন দিন বাড়তে থাকল। দুর্গাপুজোর খবরকে ছাপিয়ে গেল প্রতিবাদের খবর। সোশ্যাল মিডিয়ায় পুজোর ছবিকে পেছনে ফেলে সামনে আছে প্রতিবাদ আন্দোলনের ছবি।
এই সব ঘটনার পর কেটে গিয়েছে একটা বছর। কিন্তু এখনও বিচার কার্যত অধরা। এই কাণ্ডে জড়িত এক সিভিক পুলিশের দণ্ড হয়েছে বটে, তবে এই অভয়াকাণ্ডে শুধু একজন মামুলি সিভিক পুলিশ না, একটা গোটা ব্যবস্থাই জড়িত। কারণ তেমনটা না হলে তথ্য লোপাটের মতো অভিযোগ উঠত না। একটা ব্যাপার নিশ্চিত, সঠিক বিচার পেতে হলে রাজপথ ছাড়লে চলবে না। কারণ আমরা দেখেছিলাম, অভয়াকাণ্ডের গণআন্দোলন কিন্তু সরকারের ওপরে কিছুটা হলেও চাপ সৃষ্টি করেছিল।
তবে শুধু অভয়ার জন্য বিচার পাওয়াই নয়। আমাদের মাথায় রাখতে হবে এই লড়াই কিন্তু একটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। আমরা আশা করব এই লড়াইয়ের পর এমন একটা দিন আসবে যে দিন থেকে:
১) মেয়েদের নাম নিয়ে গালিগালাজ করা (এখনও অনেকেই সেটা করছেন) বন্ধ হবে।
২) রাস্তাঘাটে মেয়েদের কোনো অস্বস্তিকর ছোঁয়ার মুখে পড়তে হবে না।
৩) গভীর রাতে একটা মেয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্তে কাজের জায়গা থেকে বাড়ি ফিরতে পারবে। অথবা কাজের জায়গায় কাজ করতে পারবে নিশ্চিন্তে।
৪) ‘ডিভোর্সের জন্য মেয়েরাই দায়ী’ জাতীয় মন্তব্য বন্ধ হবে।
৫) কে কী পোশাক পরল, সেই নিয়ে অন্যরা কোনো মাথা ঘামাবে না।
এমনটা হলে, তবেই হবে প্রকৃত পরিবর্তন।
ছবি: লেখক
আরও পড়ুন
দিল্লি গিয়ে ‘হতাশ’, সিবিআইকে ‘বোগাস’ বললেন অভয়ার মা-বাবা