Homeপ্রবন্ধ‘বাইশে শ্রাবণ’ – বিভিন্ন দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ

‘বাইশে শ্রাবণ’ – বিভিন্ন দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ

প্রকাশিত

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

খুব সাধারণ মানুষের জীবনেও বিভিন্নভাবে রবীন্দ্রনাথ থাকেন। এই যেমন সেই ছোটোবেলার স্মৃতি, বুঝিনি তখন, শুধু দেখেছিলাম। বাইশে শ্রাবণ – আটপৌরে গেরস্তের ঘরে রবি ঠাকুরের ছবিতে রজনীগন্ধার মালা, সামনে জ্বলছে ধুপ। খাটের ওপরে, মাটিতে বসে গাওয়া হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ। সঙ্গী গীতবিতান, স্বরবিতান। ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু’ কিংবা ‘আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে কী এনেছিস বল –/হাসির কানায় কানায় ভরা নয়নের জল।’

সময়কে এগিয়ে যেতে হয়। কঠিন ব্যস্ততায় রবীন্দ্রনাথ কখনও কখনও অনুপস্থিত হয়ে পড়েন প্রাত্যহিক জীবনে। কিন্তু সেই তিনিই আবার হাত ধরে পরিণত হতে শেখান। ভাবতে শেখান। এগিয়ে যেতে শেখান। বড়ো মনের মানুষ হতে শেখান। জন্মভুমি ভারতবর্ষকে জানার জন্যে স্বামী বিবেকানন্দের সৃষ্টিসম্ভারকে পড়তে শেখান। এইভাবেই হয়তো তার পর একদিন আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাই রবীন্দ্রনাথে।

আনুষ্ঠানিক বলেই তাই ২৫শে বৈশাখ আর ২২শে শ্রাবণে রবীন্দ্রনাথ আমাদের মনের ভিতর-বাহিরে, ঘরে, ঘরের বাইরে প্রকাশিত হন বেশি করে।

‘জন্মের প্রথম শুভক্ষণ’কে তিনি যেমন অভিনন্দিত করেছেন তাঁর সৃষ্টিতে, তেমনই বোধহয় একমাত্র তিনিই বলতে পেরেছেন ‘মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান’।

মৃত্যু সত্য, জীবনের প্রথম এবং অন্তিম সত্য। যে দিন আমরা মাতৃগর্ভের নিশ্চিন্ত আশ্রয় থেকে জন্ম নিই এই পৃথিবীর নকশিকাঁথায়, সে দিনই আমাদের জন্মের দোসর হিসাবে আসে আমাদের মরণ। মাইকেল মধুসূদন দত্তের কথায় – ‘জন্মিলে মরিতে হবে’। রবীন্দ্রনাথ বললেন – ‘মরণ বলে আমি তোমার জীবনতরী বাই’।

মৃত্যু তাঁর চোখে ‘আমার মানবজন্মতরীর মাঝি’। সে জীবনের সখা, বন্ধু, প্রেমাস্পদ। সে আসবেই জীবনের কাছে নিয়তির অমোঘ ভালোবাসার টানে।

তাই তো তিনি মেলাতে পেরেছেন ‘পুলক লাগে গায়ে’-র সঙ্গে ‘তিমিরঘন আঁধারে’-র ‘নিবিড় বেদনা’-কে। তিনি উচ্চারণ করেছেন, ‘তোমার সোনার থালায় সাজাবো আজ দুঃখের অশ্রুধার’। তিনি ‘কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না’, এই কথা বলে খুঁজে নিলেন ‘চোখের জলে দুখের শোভা’। তিনি উদাসীনতায় বলে ওঠেন –  ‘আমার যে দিন ভেসে গেছে, চোখের ও জলে’।

না। রবীন্দ্রনাথ কোনো ছলনার আশ্রয় নেননি। সৃষ্টিকার যাঁরা, তাঁরা ছলনার আশ্রয় নেন না। অনেকে হয়তো তাঁদের ভুল বুঝতে পারেন, সেটা দুর্ভাগ্যের। অন্য প্রসঙ্গ। রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুকে সততায়, শ্রদ্ধায়, বিনম্র শুদ্ধতায় ভালোবেসেছেন। প্রেমে নিমজ্জিত হয়ে যাওয়াও তো এক ধরনের মরণ।

ইংরেজি সাহিত্যের কবি জন কীটস যেমন তাঁর ‘Odd to a nightangle’ কবিতায় মরণকে সম্বোধন করেছেন প্রেমিকার মতো – ‘…and for many a time/ I have been half in Love with easefull death,/ Calle’d him soft names in many a mused rhyme/ to take into the air my quite breeth;…’

কীটস-রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকার যিনি বহন করছেন সেই জীবনানন্দও মরণকে মিত্রতায় ভালোবেসেছেন – ‘মৃত্যুরে বন্ধুর মতো ডেকেছি তো, -প্রিয়ার মতন।/ চকিত শিশুর মতো তার কোলে লুকায়েছি মুখ;/ রোগীর জ্বরের মতো পৃথিবীর পথের জীবন;/ অসুস্থ চোখের ’পরে অনিদ্রার মতন অসুখ;/ তাই আমি প্রিয়তম; -প্রিয়া ব’লে জড়ায়েছি বুক…’। (জীবন)।

আর রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুকে ডাকলেন – ‘ওগো আমার এই জীবনের শেষ পরিপূর্ণতা,/ মরণ, আমার মরণ, তুমি কও আমার কথা।/ সারা জনম তোমার লাগি/ প্রতিদিন যে আছি জাগি,/ তোমার তরে বহে বেড়াই/ দুঃখসুখের ব্যথা।/ মরণ,আমার মরণ, তুমি/ কও আমার কথা।’

রবীন্দ্রনাথ কি শুধু আমাদের ভাবিয়েছেন? উত্তরে বলা যায়, না। তিনি ভাবিয়েছেন সারা বিশ্বের চিন্তাভাবনার গভীরতায় অভ্যস্ত মানুষকে। তাই তো জাপানের ওকাকুরা, ইংল্যান্ডের কবি ইয়েটস, জার্মানির মাক্সমুলার, ফ্রান্সের রোমাঁ রোলাঁ, অঁদ্রে জিঁদ, স্পেনের কবি হুয়ান রোমা হিমেনেথ, আর্জেন্তিনার ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, আলবার্ট আইন্সটাইন-সহ সারা বিশ্বের বহু বহু চিন্তাশীল দার্শনিক, কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, সংগীতকার, শিল্পী রবীন্দ্রনাথে মোহিত হয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথ বোধহয় স্বামী বিবেকানন্দের মতোই জানতেন, যে চলে যাওয়ার পরে একদিন, যেদিনটা তাঁকে ছাড়াই শুরু হবে, তাঁকে ছাড়া সেই সব বৃথা আয়োজন হয়তো, নিশ্চিত তিনি দেখতে পাবেন না, কারণ হয়তো তখন তিনি থাকবেন না। এক গভীর নিবিড় বিষাদের করুণতায় তাই বুঝি ইংরেজ কবি ক্রিস্টিনা রোসেটির ‘Remember Me, when I am gone away’ কবিতার মতো আমরা রবীন্দ্রনাথের লেখাতেও পাই ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,/ আমি বাইবো না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে,/…তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি।/ সকল খেলায় করবে খেলা এই আমি– আহা/ নতুন নামে ডাকবে মোরে, বাঁধবে নতুন বাহু-ডোরে,/ আসব যাব চিরদিনের সেই আমি।’

তিনি কথা দিয়ে গেছেন। তাই আজও তিনি ২৫শে বৈশাখে আমাদের সাথে থাকেন, ২২শে শ্রাবণেও তিনি আমাদের সাথে থাকেন। তাই একমাত্র বুঝি তিনিই সারা পৃথিবীকে বলে গেলেন – ‘…তুমি তো মৃত্যুর চেয়ে বড়ো নও।/ আমি ‘মৃত্যু-চেয়ে বড়ো’ এই শেষ কথা ব’লে/ যাব আমি চলে।’

বাইশে শ্রাবণ তাই প্রতিটি দিনের মতো বলে যায় বিনম্রতায় আমাদের মনের গহনে অস্ফুট স্বরে – ‘তবু মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে।’ ২২শে শ্রাবণের প্রতি বিনম্রতায় আজকের অনুভবে লেখা হয় – ‘না গো না, ছলনা তো নয়,/ শাশ্বত প্রিয়-প্রিয়তমা তোমার আমার পরিচয়,/ প্রেম সে তো জন্ম-জন্মান্তরের আমাদের কাহিনী,/ তুমি জানো, আর আমি জানি,/ মরণকে নিয়ে এসেছি সাথে, আর আছো সাথে তুমি/ ওগো আমার ভালোবাসা – ওগো আমার ভালোবাসার জন্মভূমি।’

আরও পড়ুন

‘নীল ধ্রুবতারা’ সলিল চৌধুরীকে তাঁর রক্তিম শতবর্ষের প্রাক্কালে বিনম্র শ্রদ্ধা

আপনার প্রশ্ন, আমাদের উত্তর

সাম্প্রতিকতম

SIR ঘোষণা হতেই ফের এনআরসি আতঙ্ক! আগরপাড়ায় আত্মঘাতী প্রৌঢ়, মুখ্যমন্ত্রীর তীব্র প্রতিক্রিয়া

আগরপাড়ায় এনআরসি আতঙ্কে আত্মঘাতী প্রদীপ কর। ঘটনাস্থলে পুলিশ কমিশনার। মুখ্যমন্ত্রীর তীব্র ক্ষোভ— “বাংলা এনআরসি মানবে না।”

ছটপূজোর পর নিউমার্কেটে বেআইনি হকারদের বিরুদ্ধে কড়া অভিযান, ফের পথে নামছে কলকাতা পুরসভা

নিউমার্কেটের আশপাশে ফের বেআইনি হকারদের দাপট। ছটপূজোর পরই রাস্তাঘাট ও ফুটপাত দখলমুক্ত করতে নামছে কলকাতা পুরসভা। টাউন ভেন্ডিং কমিটি ও কলকাতা পুলিশের যৌথ অভিযানের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

আজ সন্ধ্যায় কাকিনাড়ায় মোন্থার ল্যান্ডফল, প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা — বাংলাতে প্রভাব পড়বে ক’দিন?

আজ সন্ধ্যায় অন্ধ্রপ্রদেশের কাকিনাড়ায় ল্যান্ডফল করবে ঘূর্ণিঝড় মোন্থা। ঘণ্টায় ৯০-১০০ কিমি বেগে আছড়ে পড়বে ঝড়। বাংলায় ২৮ অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বর পর্যন্ত বৃষ্টির সম্ভাবনা, উত্তরবঙ্গে ভারী বৃষ্টি ও সিকিমে তুষারপাতের পূর্বাভাস।

কলকাতা-গুয়াংঝাউ উড়ান চালু, ভারত-চিনের সম্পর্কে উষ্ণতার ইঙ্গিত

কলকাতা: দীর্ঘ পাঁচ বছর পর আবার শুরু হল ভারত ও চিনের মধ্যে সরাসরি বিমান...

আরও পড়ুন

স্বাধীনতা আন্দোলনের অলিখিত ইতিহাস: ভুলে গিয়েছি অগ্নিস্নাত বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষকে  

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায় মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করেননি। বিধানচন্দ্র রায়কে আশীর্বাদও করেননি। বল্লভভাই পটেলের...

স্বাধীনতা আন্দোলনের অলিখিত ইতিহাস: ‘এবার তবে আসি মা!’

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায় একটা সুবৃহৎ দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস এত পক্ষপাতিত্ব করে লেখা হয়েছে, যার উদাহরণ...

স্বাধীনতা আন্দোলনের অলিখিত ইতিহাস: জালিয়ানওয়ালাবাগ ও উধম সিং

সে দিন ব্রিটিশ শাসক অসংখ্য নিরপরাধ ভারতীয় নরনারীকে বুলেটের বন্যায় ধরাশায়ী করেই ক্ষান্ত হয়নি, শহরের গণ্যমান্য নাগরিকদের ঘর থেকে বাইরে টেনে টেনে এনে রাস্তায় হামাগুড়ি দিতে বাধ্য করেছিল। প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপথে ভারতীয়দের নাকে খত দিতে বাধ্য করেছিল ব্রিটিশ শাসক সে দিন।