আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে প্রথম থেকেই। আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি মেনে নিয়ে রাজ্য সরকার পুলিশের শীর্ষ স্তরে রদবদল করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে মঙ্গলবার। তবে জুনিয়র ডাক্তারদের অভিযোগ অনুযায়ী কোনো পুলিশ কর্তার বিরুদ্ধেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, শুধু তাঁদের নতুন দায়িত্বে পাঠানো হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত পুলিশের মনোবলে কেমন প্রভাব ফেলবে, সাধারণ মানুষ কী ভাবে দেখছে এবং আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের দাবির কতটুকু পূরণ হল, সেই প্রশ্নগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পুলিশের মনোবলে কোনো প্রভাব পড়বে?
রাজ্য সরকারের এই রদবদলের সিদ্ধান্ত পুলিশ বাহিনীর মনোবলে মিশ্র প্রভাব ফেলতে পারে। যাঁরা আরজি কর কাণ্ডের তদন্তের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন, তাঁদেরকে অপসারণ না করে নতুন দায়িত্বে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে অনেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস হিসেবে দেখবেন। এটি একটি ‘দায়িত্বের পুনর্বিন্যাস’ এবং তা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না হওয়ায়, পুলিশের মনোবলে নেতিবাচক প্রভাবের সম্ভাবনা কম। কিন্তু পুলিশ বাহিনীর মধ্যে একটি ধারণা বদ্ধমূল হতে পারে যে, ভুল করার পরেও তাদের কর্মজীবন বা পেশাগত দায়িত্বে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে না।
তবে, একইসঙ্গে এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে যেখানে পুলিশের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে পেশাদারিত্বের অভাব ঘটতে পারে। যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যর্থতা সত্ত্বেও শাস্তি বা কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না, তখন বাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলার অভাব দেখা দিতে পারে। শাস্তির অভাবে ভুলের পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা থাকে এবং দায়িত্ব পালনে গাফিলতির সম্ভাবনা বাড়ে। পুলিশকর্মীরা যদি বুঝতে পারেন যে, তাঁদের ভুলের জন্য কোনো জবাবদিহিতা করার দরকার নেই, তাহলে তাঁদের পেশাদারিত্ব ও দায়িত্বশীলতায় ঘাটতি দেখা দিতে পারে। তবে এটাও বলে রাখা ভালো যে, সংশ্লিষ্ট পুলিশকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ উঠলেও সেগুলো কতটা সত্য, তা এখনও তদন্ত সাপেক্ষ।
সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া কী রকম?
সাধারণ মানুষ এই রদবদলকে কীভাবে দেখছে, তার ওপর নির্ভর করছে সরকারের ভাবমূর্তি ও পুলিশের প্রতি বিশ্বাস। আরজি কর কাণ্ডে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পর সাধারণ মানুষের মধ্যে পুলিশের নিরপেক্ষতা নিয়ে যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে, তা এই সিদ্ধান্তে পুরোপুরি প্রশমিত হয়নি। অনেকেই মনে করছেন, পুলিশ প্রশাসনের ওপর সরকারের অতিরিক্ত প্রভাব রয়েছে, যার ফলে সঠিক ভাবে তদন্ত ও শাস্তি হচ্ছে না।
সাধারণ মানুষ মনে করছে, পুলিশ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত যদি শুধুমাত্র রদবদলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে এবং কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া কঠিন। এই পরিস্থিতিতে, জনগণের আস্থা কমলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
অন্যদিকে, সরকারের এই সিদ্ধান্তের মধ্যে সাধারণ মানুষের একাংশ রাজনীতির গন্ধ পাচ্ছে। কোনো রকম শাস্তি না দিয়ে রদবদলের মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে বলে তাদের ধারণা। জনগণ যদি দেখে যে পুলিশ প্রশাসন দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলেও কোনো শাস্তি নেই, তাহলে তারা পুলিশের প্রতি আস্থা হারাবে। এর ফলে পুলিশি ব্যবস্থার স্বচ্ছতার উপর জনগণের মধ্যে বিশ্বাস কমে যায়।
আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি কতটা পূরণ হল?
আরজি কর কাণ্ডে আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের প্রধান দাবি ছিল, হাসপাতালে নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত করা এবং ঘটনার দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে শুধু রদবদল করায় তাঁদের দাবি কতটা পূরণ হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
আন্দোলনকারীরা যে মূলত পুলিশের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ ও নির্ভুল তদন্ত এবং দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তি চেয়েছিলেন, তা এখনও কার্যকর হয়নি। শাস্তির পরিবর্তে পুলিশ কর্মকর্তাদের শুধু অন্য পদে পাঠানো হয়েছে। এর ফলে আন্দোলনকারীদের মধ্যে হতাশা এবং ক্ষোভ থাকতে পারে, কারণ তাঁদের প্রধান দাবি ছিল দায়িত্বহীনতার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া। সেটা পূরণ না হওয়ায় তাঁদের আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য এখনও অপূর্ণ রয়ে গেছে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, জুনিয়র ডাক্তাররা যেসব পুলিশকর্তারা দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন, তাঁরা আদৌ কোনো গাফিলতি করেছেন কিনা, তার তদন্ত করবে সিবিআই এবং বিচার করবে আদালত।
জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি ছিল তাঁদের নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বিশ্লেষকদের মতে, পুলিশের ব্যর্থতা বা দায়িত্বহীনতার কারণে তাঁদের নিরাপত্তার প্রশ্নে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু, বর্তমান সিদ্ধান্ত সেই দাবি পুরোপুরি পূরণ করতে পারেনি। শুধুমাত্র প্রশাসনিক ভাবে রদবদল করে সমস্যার সমাধান হবে কি, সেই প্রশ্নটি থেকেই যায়।
এই পরিস্থিতিও সরকারের সামনে একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ বলে ধরে নেওয়া যেতে। জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে হলে পুলিশ প্রশাসনের সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিরপেক্ষ ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায়, এই ধরনের ঘটনাগুলি ভবিষ্যতে আরও বড় সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। সেক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের মনে পুলিশের প্রতি আস্থার অভাব আরও গভীর হবে।
আরও পড়ুন: নিরপেক্ষতা এবং আস্থা ফেরানোই এখন পুলিশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ