Homeপ্রবন্ধসীতারাম ইয়েচুরি: ভারতীয় বামপন্থী রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের দিশারি

সীতারাম ইয়েচুরি: ভারতীয় বামপন্থী রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের দিশারি

প্রকাশিত

ভারতের অন্যতম প্রভাবশালী কমিউনিস্ট নেতা এবং সিপিএম-এর সফলতম সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। তাঁর রাজনৈতিক জীবন ভারতীয় বামপন্থী রাজনীতির ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন সংগ্রাম, আদর্শ ও দলীয় নেতৃত্বের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। সিপিএমের নেতৃত্বে সীতারাম ইয়েচুরি তাঁর প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তা, এবং দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সারা দেশে সুপরিচিত।

রাজনৈতিক জীবনে শিক্ষাজীবনের প্রভাব

সীতারাম ইয়েচুরি ১২ আগস্ট ১৯৫২ সালে তেলঙ্গনার মাধানাপল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন ইয়েচুরি সি রাজেশ্বর রাও, যিনি নিজেও একজন সক্রিয় কমিউনিস্ট ছিলেন। বাবার প্রভাবে ছোটবেলা থেকেই ইয়েচুরি বামপন্থী রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন। তাঁর শিক্ষা জীবনও তাঁর রাজনৈতিক জীবনকে প্রভাবিত করে। তিনি দিল্লির ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেন্ট স্টিফেন কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক হন। পরবর্তীতে, তিনি জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় (জেএনইউ) থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন, যা তাঁর রাজনৈতিক জীবনে একটি মোড় তৈরি করে। জেএনইউতে থাকাকালীনই তিনি ছাত্ররাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং ছাত্র ফেডারেশন অব ইন্ডিয়া (এসএফআই)-এর সক্রিয় সদস্য হয়ে ওঠেন।

ছাত্র রাজনীতি ও সিপিএম

সীতারাম ইয়েচুরি জেএনইউতে পড়াশোনা করার সময় ভারতীয় ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭৫ সালে যখন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন, তখন ইয়েচুরি তার রাজনৈতিক কেরিয়ারের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শুরু করেন। এই জরুরি অবস্থার সময় তিনি সরকারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন এবং গ্রেফতার হন। এই সময়কালের অভিজ্ঞতা তাঁকে ভারতের বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে যুক্ত করে।

১৯৭৪ সালে সীতারাম ইয়েচুরি আনুষ্ঠানিকভাবে সিপিএম-এ যোগ দেন। তাঁর রাজনৈতিক জ্ঞান, সংগঠনের প্রতি নিবেদন, এবং বামপন্থী আদর্শের প্রতি আস্থা তাঁকে দ্রুত দলে উচ্চ পর্যায়ের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। তাঁর ছাত্র আন্দোলনের সফলতা এবং নেতৃত্বের গুণাবলী তাঁকে সিপিএম-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে তুলে ধরে। ১৯৮৪ সালে তিনি সিপিএম-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন এবং পরবর্তীতে দলের পলিটব্যুরোতে জায়গা করে নেন।

কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও পার্টির পুনর্গঠন

সিপিএম-এ সীতারাম ইয়েচুরির নেতৃত্বের যুগের সূচনা হয় ২০১৫ সালে, যখন তিনি দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। এই পদে তাঁর নির্বাচন ভারতীয় বামপন্থী রাজনীতির একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হিসেবে দেখা হয়। ইয়েচুরি কেবলমাত্র ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, বরং আন্তর্জাতিক মঞ্চেও বামপন্থী আদর্শকে তুলে ধরেছেন। তিনি আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সিপিএম-এর সম্পর্ককে মজবুত করেছেন।

সিপিএম-এর নেতৃত্বে ইয়েচুরি দলের পুনর্গঠনের জন্য নানা পদক্ষেপ নেন। তাঁর সময়ে পার্টি সদস্যদের মধ্যে একতা বজায় রাখা এবং দলের আদর্শগত ভিত্তিকে মজবুত করা ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। ভারতীয় রাজনীতিতে নব্য উদারনীতিবাদ এবং দক্ষিণপন্থী শক্তির উত্থানের সময় তিনি বামপন্থী রাজনীতির প্রতিপালক হিসেবে কাজ করেছেন। সিপিএম-এর ঐতিহ্যবাহী কর্মসূচি ও আদর্শের সঙ্গে সমন্বয় রেখে ইয়েচুরি দলকে বর্তমান যুগের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর নেতৃত্বে দল নতুন সদস্য সংগ্রহ, রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ, এবং বামপন্থী আদর্শের প্রসারে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে।

সংসদীয় জীবন ও জনসংযোগ

সীতারাম ইয়েচুরি শুধুমাত্র দলের নেতা হিসেবে নয়, সংসদীয় রাজনীতিতেও একজন অভিজ্ঞ নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তিনি রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে দুবার দায়িত্ব পালন করেছেন এবং সংসদে বামপন্থী মতাদর্শের পক্ষে জোরালো বক্তব্য রেখেছেন। সংসদে তাঁর ভূমিকা সাধারণ মানুষের সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে সংযুক্ত করেছে। ইয়েচুরির সংসদে বক্তৃতা তাঁর তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও যুক্তিনিষ্ঠ অবস্থানের জন্য প্রশংসিত হয়েছে। তিনি কৃষক, শ্রমিক এবং সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর অধিকার রক্ষার জন্য প্রতিনিয়ত আওয়াজ তুলে আসছেন।

আদর্শগত স্থিরতা এবং নীতিগত অবস্থান

সীতারাম ইয়েচুরি তাঁর পুরো রাজনৈতিক জীবনে বামপন্থী আদর্শের প্রতি অটল থেকেছেন। যদিও বিভিন্ন সময়ে ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্র ও সমাজে নানা পরিবর্তন এসেছে, ইয়েচুরি তাঁর দলের আদর্শিক অবস্থান থেকে কখনও সরে আসেননি। ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কৃষক সমস্যা, শ্রমিকের অধিকার, এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনি সবসময়ই সোচ্চার। বিশেষত, ভারতের নয়া উদারনীতিক অর্থনৈতিক নীতির সমালোচক হিসেবে তিনি বারবার সরকারের নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন।

সমালোচনা ও চ্যালেঞ্জ

সীতারাম ইয়েচুরি বামপন্থী রাজনীতির একজন সফল নেতা হলেও তাঁর নেতৃত্বে দলকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ এবং কেরলের মতো রাজ্যে বামফ্রন্টের রাজনৈতিক অবনতি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়ায়। দলের ভেতরেও মাঝে মাঝে আদর্শগত মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। তবে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইয়েচুরি তাঁর নেতৃত্বের কৌশল এবং দলীয় সংহতির প্রতি জোর দিয়েছেন।

আরও পড়ুন: ২৫ দিনের লড়াই শেষ, প্রয়াত সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরি

আপনার প্রশ্ন, আমাদের উত্তর

সাম্প্রতিকতম

নির্বাচনে ২৩৭ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করল বিএনপি, তিন আসনে লড়বেন খালেদা জিয়া, নির্বাচনে নামছেন ছেলে তারেক রহমানও

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রার্থী ঘোষণা করল বিএনপি। ২৩৭ আসনে একক প্রার্থী দিচ্ছে দলটি। তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন খালেদা জিয়া, বগুড়া-৬ থেকে নির্বাচনে নামছেন তারেক রহমান।

পাকিস্তান-সহ ৪ দেশ পরমাণু গোপনে পরমাণু পরীক্ষা চালাচ্ছে, তাই আমেরিকাও শুরু করবে, জানিয়ে দিলেন ট্রাম্প

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করলেন, পাকিস্তান-সহ একাধিক দেশ গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা চালাচ্ছে। তাই ৩০ বছর পর আমেরিকারও পারমাণবিক পরীক্ষা ফের শুরু করা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন তিনি।

সাত বছর পর ঘরে ফেরা! তৃণমূলে ফিরলেন শোভন চট্টোপাধ্যায়, সঙ্গে বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়

দীর্ঘ সাত বছর পর আবার তৃণমূলে ফিরলেন কলকাতার প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। সোমবার দুপুরে তৃণমূল ভবনে সুব্রত বক্সী ও অরূপ বিশ্বাসের হাতে উত্তরীয় পরে আনুষ্ঠানিক প্রত্যাবর্তন করলেন তিনি ও বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়।

তেলঙ্গানায় ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা! লরির সঙ্গে বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে মৃত অন্তত ২৪, বহু আহত

তেলঙ্গানার রঙ্গা রেড্ডি জেলায় ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ২৪ জনের মৃত্যু। ভারী লোড-বোঝাই লরি মুখোমুখি ধাক্কা দেয় রোড ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশনের বাসকে। আহতদের হাসপাতালে ভর্তি, দুর্ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও মুখ্যমন্ত্রী রেবন্ত রেড্ডি।

আরও পড়ুন

স্বাধীনতা আন্দোলনের অলিখিত ইতিহাস: ভুলে গিয়েছি অগ্নিস্নাত বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষকে  

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায় মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করেননি। বিধানচন্দ্র রায়কে আশীর্বাদও করেননি। বল্লভভাই পটেলের...

স্বাধীনতা আন্দোলনের অলিখিত ইতিহাস: ‘এবার তবে আসি মা!’

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায় একটা সুবৃহৎ দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস এত পক্ষপাতিত্ব করে লেখা হয়েছে, যার উদাহরণ...

স্বাধীনতা আন্দোলনের অলিখিত ইতিহাস: জালিয়ানওয়ালাবাগ ও উধম সিং

সে দিন ব্রিটিশ শাসক অসংখ্য নিরপরাধ ভারতীয় নরনারীকে বুলেটের বন্যায় ধরাশায়ী করেই ক্ষান্ত হয়নি, শহরের গণ্যমান্য নাগরিকদের ঘর থেকে বাইরে টেনে টেনে এনে রাস্তায় হামাগুড়ি দিতে বাধ্য করেছিল। প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপথে ভারতীয়দের নাকে খত দিতে বাধ্য করেছিল ব্রিটিশ শাসক সে দিন।