Home দুর্গাপার্বণ স্বদেশির গন্ধমাখা উত্তরপাড়া চ্যাটার্জিবাড়ির ৩০২ বছরের দুর্গাদালান

স্বদেশির গন্ধমাখা উত্তরপাড়া চ্যাটার্জিবাড়ির ৩০২ বছরের দুর্গাদালান

0

পাপিয়া মিত্র

এক দিন এই ঠাকুরদালানে অরবিন্দ, সুভাষচন্দ্র বসু, বাঘা যতীন, চিত্তরঞ্জন দাশ, সুবোধ মল্লিক-সহ বহু জনের পা পড়েছিল। এই দালানের গা ঘেঁষে উঠে যাওয়া সিঁড়ি শেষ হয়েছে যে মঠের ঘরে, সেই ঘরেই বসত বিপ্লবীদের সভা। কড়া নজর রাখতেন অমরেন্দ্রনাথের স্ত্রী, ঠাকুমা ও মেজোপিসিমা ননীবালা দাসী। এ বাড়ির পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে বিপ্লবীদের গন্ধ।

হুগলির উত্তরপাড়া সে কালের বর্ধিষ্ণু গ্রাম, আজ ঝাঁ চকচকে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় উজ্জ্বল। কিন্তু সেই আধুনিকতা এতটুকু থাবা বসায়নি চট্টোপাধ্যায় পরিবারের ঠাকুরদালান বা দুর্গাপুজোয়। পশ্চিমের গরলগাছা গ্রামের রামনিধি চট্টোপাধ্যায় উত্তরপাড়ার সাবর্ণদের মেয়েকে বিয়ে করে হলেন ‘উত্তরপাড়ার জামাই’। ইটখোলা ও অন্যান্য ব্যবসায় প্রচুর অর্থ উপার্জন করে জমিদারি কিনে ফেললেন। পত্তন করলেন ‘চাটুজ্যেবাড়ি’-র দুর্গাপুজোর, সেই ১৭২১-এ।

বিপ্লবী অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় এই বাড়িরই সপ্তম পুরুষ। এই বাড়িরই কোণের ঘরে আত্মগোপন করেছিলেন লোকনাথ বল, প্রফুল্ল সেন, বসন্ত বিশ্বাসরা। এ সব শুনেছিলাম অমরেন্দ্রনাথের নাতি কুমারদেবের মুখে। সে-ও তো হয়ে গেল বেশ কয়েকটা বছর।

অমরেন্দ্রনাথের পিতা উপেন্দ্রনাথ বলে গেছিলেন, মাটির দালান যেন কোনো দিন সিমেন্টের না হয়। ষষ্ঠ পুরুষের সেই নির্দেশের সাক্ষী হয়ে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী শেওলাধরা ঠাকুরদালানের মাটি। যে বাড়ির পুজো আজও সেই সাবেকিয়ানা বহন করে চলেছে তার অতীত কুলগুরুরা কে ছিলেন? ভূতনাথ, তুকারাম, সচ্চিদানন্দের মতো কুলগুরুরা এক সময়ে পুজোর দালান আলো করে রাখতেন।

তখনকার দিনে পুজোর পরে সকলকে দেওয়া হত জিলিপি-বোঁদে-গজা-দরবেশ। সবই তৈরি হত বাড়িতে। গ্রামের জনসংখ্যাও তো কম ছিল না। সেই হিসেব ধরে সপ্তমীতে নিমন্ত্রিতদের সংখ্যা হত সাত-আটশো, অষ্টমীতে তা বেড়ে হত বারোশো। আর নবমীতে গিয়ে দাঁড়াত পনেরোশোতে। দশমীতে বাড়ির আত্মীয়স্বজন আর জলভারীদের নিয়ে প্রায় আড়াইশো।

অতীতে ফিরে গিয়েছিলেন নব্বই উত্তীর্ণ নবগোপাল চট্টোপাধ্যায়, অমরেন্দ্রর খুড়তুতো ভাই। নবগোপালবাবু বলেছিলেন – দুর্গাপুজোর সময় বাড়িতে মিষ্টি তো বানানো হতই, তা ছাড়াও কলকাতা আর কৃষ্ণনগর থেকে আসত মিষ্টি। জনাই থেকে আসত মনোহরা, নাটোরের কাঁচাগোল্লা। শাক-শুক্তো-ঘণ্ট-ডাল-ডালনা-মাছ-মাংস-পোলাও-খিচুড়ি ও সাদা ভাতের সঙ্গে থাকত ৭-৮ রকমের ভাজা। রান্নার বহরও কম ছিল না। ভাত চড়ত ষোলো পাকের উনুনে। ভাতঘরে শান বাঁধানো মেঝেতে কাপড় পেতে ঢালা হত ভাত। নান্দার বাজার থেকে আসত তিন গোরুর গাড়িভরতি সবজি।

বৈঠকখানার সেই বিখ্যাত ঘরে বসে পুত্র যোগব্রত শুনিয়েছিলেন বাবা অমরেন্দ্রনাথের কথা। সে-ও তো হয়ে গেল বছর ২০-২১।

যোগব্রত শুনিয়েছিলেন কী ভাবে স্বদেশি আন্দোলনে মাতলেন অমরেন্দ্র। ঠাকুরদা উপেন্দ্রনাথ ওকালতি করে বিপুল পয়সাকড়ি করেছিলেন। কিন্তু পুত্র অমরেন্দ্র সেই দিকে না গিয়ে স্বদেশি আন্দোলনে যোগ দিলেন। ১৮৮০-এর ১ জুলাই অমরেন্দ্রর জন্ম। শিক্ষা উত্তরপাড়া ও ভাগলপুরে। তার পরে কলকাতার ডাফ কলেজে (স্কটিশ চার্চ)। সেই সময় স্বামী বিবেকানন্দের উদাত্ত আহ্বান বাংলার যুবকদের ধর্ম ও দেশাত্মবোধে অনুপ্রাণিত করেছিল। মা সরলাদেবীর কাছে সন্ন্যাস নেওয়ার কথা পেড়েছিলেন অমরেন্দ্র। সরলাদেবী বলেছিলেন, ‘তুমি সন্ন্যাস নেবে কেন? তুমি কর্মযোগী হও’। অমরেন্দ্রনাথ সেই কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। ১৯০৫ সাল। কার্জনের বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েছে বাংলাদেশ। রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’য় উত্তাল বাংলা। স্বদেশির হাওয়া দেশ জুড়ে। অমরেন্দ্রও বসে থাকতে পারলেন না। যোগ দিলেন স্বদেশি আন্দোলনে। স্বদেশি নুন-চিনি-কাপড়ের প্রচারে নেমে পড়লেন। বাড়িতে ছ’খানি তাঁত বসিয়ে কাজ আরম্ভ করে দিলেন।

যোগব্রতবাবু সে দিন বলেছিলেন, “বাবা জানতেন, এই আন্দোলন আসলে স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলন নয়। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে একটা আন্দোলন। এর থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের সুচনা হবে। আর এই আন্দোলনে যত অত্যাচার বাড়বে, তত স্বাধীনতা আন্দোলন প্রসার লাভ করবে। ক্রমে অরবিন্দের সংস্পর্শে আসেন অমরেন্দ্র। বাংলা যেন নবজন্ম লাভ করল। শুরু হল ‘যুগান্তর’, ‘সন্ধ্যা’, ‘নবশক্তি’ পত্রিকার যুগ। এই আন্দোলনে অমরেন্দ্রর দায়িত্ব ছিল অর্থের জোগান দেওয়া। তৈরি হল সন্তান দল। অমরেন্দ্রের নেতৃত্বে উত্তরপাড়া ক্রমে এপার বাংলার বরিশাল হয়ে উঠল।”

যোগব্রতবাবু, কুমারবাবু এখন আর নেই। তবুও তাঁদের কাছ থেকে শোনা কথা আজ না  লিখলেই নয়। বৈঠকখানার কোণের ঘরে অনেক ঘটনার সাক্ষী শ্বেতপাথরের গোলটেবিলখানি। তারই পাশে বসে যোগব্রতবাবু শুনিয়েছিলেন আরও এক রোমাঞ্চকর কাহিনি। রাত দু’টো। বাবা বাড়ি আছেন জেনে কালো ওভারকোট পরা কয়েক জন বাড়ি ঘিরে ফেলেছেন। বাবা ঠাকুমাকে তা দেখালেন। ঠাকুমা জানতে চাইলেন, ‘লুকোনোর কিছু আছে কি না!’ তখন যুগান্তরে প্রকাশিত লেখাগুলো ছিল বিপদের বস্তু। আর ছোটো পিস্তলটি মা বালিশের সেলাই খুলে লুকিয়ে রাখলেন। অমরেন্দ্র নিজে দরজা খুলে দেখলেন হুগলি জেলার পুলিশ সুপার রায়ন, সহকারী ডেপুটি দীনবন্ধু ভৌমিক, গোয়েন্দাকর্তা যতীন মুখোপাধ্যায় ও কলকাতা পুলিশের চার-পাঁচজন। ধরা পড়লেন অমরেন্দ্র।

অমরেন্দ্রের তৈরি ‘অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি’ রজনীকান্তের ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ গেয়ে স্বদেশি প্রচার করত। তাঁর তৈরি শ্রমজীবী সমবায় পরে কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়। হাতে কলমে শিক্ষার জন্য যে বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন জেলে যাওয়ার ফলে তা বন্ধ হয়ে যায়। পরে সেই বিদ্যালয় অমরেন্দ্র বিদ্যাপীঠ নামে খ্যাত হয়। তিনি উত্তরপাড়া ফিল্ম অ্যাকাডেমি স্থাপন করেন। ধর্মরক্ষিণী সভার পাশাপাশি নৌবাহিনীও গঠন করেন। তবে শুধু অমরেন্দ্রবাবু নন, তাঁর মেজোভাই বরেন্দ্রনাথও ছিলেন বিপ্লবী। দক্ষিণেশ্বরে বোমা কারখানার কাজে তিনি সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন।

‘চাটুজ্যেবাড়ি’-র গা থেকে সহজে যেতে চায় না বিপ্লবী গন্ধ। অমরেন্দ্র ও বরেন্দ্রনাথের মেজোপিসি ছিলেন ননীবালা দাসী। বিপ্লবী মহলে তিনি মেজোপিসিমা নামে পরিচিত ছিলেন। অমরেন্দ্র, অতুল ঘোষ, যদুগোপাল প্রমুখ বিপ্লবীর গোপন আস্তানার কর্ত্রী ছিলেন ননীবালা। ব্রাহ্মণ পরিবারের নিষ্ঠাবতী বিধবা মাউজার পিস্তলের হদিস জানার জন্য এক বন্দির স্ত্রী বলে পরিচয় দিয়ে জেলে সেই বন্দির সঙ্গে দেখা করেন এবং পিস্তলের হদিস জেনে সেই খবর আদানপ্রদান করেন। পুলিশ সে খবর জানতে পেরে তাঁকে গ্রেফতার করে। বহু নির্যাতনেও মুখ খোলেননি তিনি। ঘটনাটা ১৯১৫ সালের। ননীবালাই ভারতবর্ষের প্রথম ও একমাত্র বিনা বিচারে আটক রাজবন্দিনী, যাকে ১৮১৮ সালের ৩ নম্বর রেগুলেশনে বন্দি করা হয়।

এখন সেই মানুষরা নেই, নেই সেই জাঁকও। কিন্তু ঐতিহ্যের জৌলুস অটুট আছে ‘চাটুজ্যেবাড়ি’-র নবীন প্রজন্মের হাত ধরে। পরিবার ছোটো হয়েছে, এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়েছেন অনেকেই। এখন সকলের এক হওয়ার জন্য চেয়ে থাকতে হয় উৎসবের দিকে। পুজোর ক’টি দিনে ভাইবোনেরা বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে জড়ো হয় ঠাকুরদালানে। পুরোনো ধারা মেনে যথাবিহিত ভাবে পূজা সম্পন্ন হয়।

বিপ্লবী অমরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, শক্তি আরাধনার মধ্যে দিয়ে দেশের মুক্তি সম্ভব। তাই পুজো চালিয়ে গেছিলেন। কিন্তু কমিয়ে দিয়েছিলেন আড়ম্বর। আড়ম্বর কমিয়ে সেই টাকা স্বদেশের কাজে ব্যয় করতে পিছপা হননি ‘চাটুজ্যেবাড়ি’-র মা-বোনেরাও। তাই উত্তরপাড়ার ‘চাটুজ্যেবাড়ি’-র পুজোয় হয়তো সেই চোখধাঁধানো বৈভব নেই। কিন্তু যা আছে তা-ই বা কম কী? আছে স্বদেশিয়ানার এক সাড়ম্বর ঐতিহ্য। স্মৃতির সেই ঐতিহ্যে আজও আলোকিত ৩০২ বছরের ঠাকুরদালান।

আরও পড়ুন

৮৭তম বছরে দক্ষিণ কলকাতার ‘শিবমন্দির’-এর পুজোর থিম ‘আগল’   

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version