Home দুর্গাপার্বণ ভট্টাচার্য বংশের ‘মঠের বাড়ির দুর্গোৎসব’-ই সিঙ্গি গ্রামের সবচেয়ে প্রাচীন দুর্গাপূজা

ভট্টাচার্য বংশের ‘মঠের বাড়ির দুর্গোৎসব’-ই সিঙ্গি গ্রামের সবচেয়ে প্রাচীন দুর্গাপূজা

0

কেনারাম ভট্টাচার্য (সেবাইত)

পূর্ব বর্ধমান জেলার সিঙ্গি গ্রামের খ্যাতি বাংলায় মহাভারত রচয়িতা মহাকবি কাশীরাম দাসের জন্মভূমি হিসাবে। এই সিঙ্গি গ্রামের সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যশালী পূজা হল ভট্টাচার্য বংশের ‘মঠের বাড়ির দুর্গাপূজা’। এই দুর্গাপূজা ঠিক কতটা প্রাচীন তার সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলেও এর বয়স যে সাড়ে তিনশো বছরেরও বেশি তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

মঠের বাড়ির পুজোর ইতিহাস

কথিত আছে, এক সময়ে সিঙ্গি গ্রামের ভট্টাচার্যদের কোনো এক পূর্বপুরুষ বর্ধমান রাজবাড়ির কুলপুরোহিত ছিলেন। তিনি জ্যোতিষশাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন। এই কুলপুরোহিতকে বর্ধমানরাজ অত্যন্ত ভক্তিশ্রদ্ধা করতেন। রাজবাড়ির দুর্গাপূজাও এই পুরোহিতই করতেন। ক্রমে তাঁর বয়স বাড়ল। একদিন রাজাকে জানালেন, তাঁর পক্ষে আর এই কুলপুরোহিতের গুরু দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি ছুটির আবেদন জানালেন। আর তাঁর ইচ্ছার কথা জানালেন। তিনি চান, নিজের গ্রাম সিঙ্গিতে ফিরে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে জীবনের বাকি দিনগুলো কাটাবেন।

কুলপুরোহিতের আর্জি শুনে মহারাজ দুঃখ পেলেও তিনিও তাঁর ইচ্ছার কথা জানালেন। তাঁর ইচ্ছা, কুলপুরোহিত সিঙ্গি গ্রামে ফিরে গিয়ে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দুর্গাপূজা শুরু করুন। এর জন্য মহারাজ তাঁর রাজ্যের অধীনে ইন্দ্রাণী পরগণায় ৪০০ বিঘা নিষ্কর সম্পত্তি কুলপুরোহিতকে দান করলেন এবং কিছু নগদ টাকাও দিলেন। কুলপুরোহিত সিঙ্গি গ্রামে ফিরে গিয়ে মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দুর্গাপূজা শুরু করলেন। শুরু হল সিঙ্গিতে ‘মঠের বাড়ির  দুর্গাপূজা’। সেই পূজাই আজও হয়ে আসছে।  

মঠের বাড়ির দুর্গাপূজার বৈশিষ্ট্য

মঠের বাড়ির নিয়ম মেনে সিঙ্গি গ্রামের অন্যান্য দুর্গাপূজা চালিত হয়। বর্তমানে গ্রামে চারটি পারিবারিক পূজা এবং ১৪টির মতো সর্বজনীন পূজা হয়। একমাত্র মঠের বাড়ির দুর্গাপূজায় কৃষ্ণানবমী তিথিতে ধুমধাম করে বাদ্যিবাজনা সহকারে দেবীর ঘট আনা হয় এবং সে দিন ছাগবলি ও নানা প্রকার ভোগ-অন্ন দিয়ে দেবীর পূজা শুরু হয়। ১২ দিন ধরে একটি নির্দিষ্ট ঘরে দু’ বেলা পূজা হয়।

এর পর শুক্লাসপ্তমী তিথিতে নবপত্রিকা স্নানের মধ্য দিয়ে কলাবউকে নিয়ে আসা হয় এবং মূল মন্দিরে মায়ের পূজা শুরু হয়। সপ্তমী, অষ্টমী, মহাসন্ধি ও নবমী তিথিতে শাস্ত্র মেনে পূজা হয় ও প্রতি দিন একটি করে ছাগ বলি হয়। সন্ধিপূজার দিন ছাগবলির ২ মিনিট আগে ঢাক ও বাজনা বাজিয়ে বহু দূর থেকে ঢাকি আসেন। এক অদ্ভুত পরিবেশ সৃষ্টি তৈরি হয়। বলিকাষ্ঠের কাছে পাটকাঠির মশাল জ্বালানো হয়। বহু গ্রামের লোক এই মুহূর্তটি দেখার জন্য ভিড় করেন।

মঠের বাড়ির সন্ধিপূজার বলিদানের পর অন্যান্য জায়গায় বলিদান হয়। আগে দোনলা বন্দুক থেকে গুলি ছুড়ে পার্শ্ববর্তী মালঞ্চ, ছোটো মেইগাছি গ্রামের পূজাগুলিকে সন্ধিপূজায় বলিদান শুরু করার সংকেত দেওয়া হত। এখন অবশ্য সকলে ঘড়ি ধরে বলিদান সম্পন্ন করেন।

প্রতি দিন বলিদানের পর সেই ছাগমাংস রান্না করে মঠের বাড়ির মাকে ভোগের সঙ্গে দেওয়া হয়। এটি মঠের বাড়ির দুর্গাপূজার বৈশিষ্ট্য। আর একটি বৈশিষ্ট্য হল মঠের বাড়ির দুর্গাপূজার পুরোহিত সেবাইতদের মধ্য থেকেই নির্বাচিত হন। অন্য কোনো পুরোহিত পূজা করতে পারেন না। এই নিয়ম পূজার সূচনা থেকেই চলে আসছে।

দুর্গাপূজার নবমীর দিন ভট্টাচার্য বংশের সকল সেবাইত ও তাঁদের পরিবার-পরিজন মায়ের মন্দিরে একত্রিত হয়ে আনন্দ করে পংক্তিভোজন করেন। দশমীর দিন আনুমানিক ১০০ জন সেবাইত মাকে পুষ্পাঞ্জলি দেন এবং মেয়েরা সিঁদুরখেলায় মাতেন। দশমীর বিকেলে বাদ্যিবাজনা সহকারে গোটা গ্রাম প্রদক্ষিণ করে মঠের মাকে নির্দিষ্ট পুকুরে বিসর্জন দিয়ে সকলে কোলাকুলি করেন এবং শুরু হয় বিজয়ার প্রণাম। আর সবাই প্রার্থনা করেন, ‘মাগো সামনের বছর আবার এসো’।

আরও পড়ুন

জমিদারি চলে গেলেও ঐতিহ্য হারায়নি জয়নগর মিত্রবাড়ির ৩০০ বছরের পুজোর

 ১৪২ বছর ধরে সব প্রথা মেনে পুজো হয়ে আসছে বলরাম দে স্ট্রিটের দত্তবাড়িতে

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version