নিজস্ব প্রতিনিধি: উপলক্ষ্যটা ছিল ক্যালকাটা জার্নালিস্টস ক্লাবের ৪৫তম বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান। বুধবার সেই অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছিল রবীন্দ্র সদন প্রেক্ষাগৃহে। প্রথম পর্বে প্রথাগত কিছু অনুষ্ঠানের পর দ্বিতীয় পর্বে ছিল সমদীপ্তা মুখার্জির সংগীত পরিবেশন। সমদীপ্তা তাঁর পারফরম্যান্সে আবিষ্ট করে রাখলেন শ্রোতা-দর্শকদের, মাতিয়ে দিলেন সবাইকে।
সমদীপ্তার পরিবেশনায় কী ছিল না! পুরোনো দিনের আধুনিক বাংলা গান, পুরোনো হিন্দি ফিল্মের গান, জগজিৎ সিংয়ের গজল, লোকসংগীত এবং রবীন্দ্রসংগীত। এ দিন তিনি তাঁর সংগীতের ভাণ্ডার উজাড় করে দিলেন শ্রোতা-দর্শকদের কাছে। মোহিত শ্রোতা-দর্শককুল।
‘অয়ি গিরি নন্দিনি নন্দিতমেদিনি বিশ্ব-বিনোদিনি নন্দনুতে’ – অনুষ্ঠানের সূচনাতেই আদি শঙ্করাচার্য রচিত মহিষাসুরমর্দিনী স্তোত্রম্ পরিবেশন করে সমদীপ্তা প্রেক্ষাগৃহে সঠিক পরিবেশটি রচনা করে ফেললেন।
এর পর শিল্পীকে বরণ করে নেওয়ার পালা। সমদীপ্তাকে বরণ করলেন ক্লাবের তরফ থেকে সভাপতি প্রান্তিক সেন ও সাধারণ সম্পাদক ইমন কল্যাণ সেন এবং ক্লাবের দুই সদস্য স্বস্তিকা রায় ও সঙ্গীতা চৌধুরী। ক্লাবের পক্ষ থেকে সমদীপ্তার হাতে তুলে দেওয়া হল একটি গিটার। উপহার পেয়ে সমদীপ্তা তাঁর খুশি গোপন রাখেননি। তিনি পরিষ্কার জানালেন, একজন সংগীতশিল্পীর কাছে এর চেয়ে বড়ো উপহার আর কী হতে পারে।
আবার শুরু করলেন সমদীপ্তা। এ বার হিন্দি ভজন – এক রাধা এক মীরা দোনোঁ নে শ্যাম কো চাহা’। বলিউডের একসময়ের বিখ্যাত ছবি রাজ কাপুরের ‘রাম তেরি গঙ্গা মইলি’তে রবীন্দ্র জৈনের কথা ও সুরে এই গানটি গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর। লতার সেই বিখ্যাত ভজন গেয়ে মাত করলেন সমদীপ্তা। তার পরেই চলে গেলেন আরতি মুখোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত গানে ‘তখন তোমার একুশ বছর বোধহয়, আমি তখন অষ্টাদশীর ছোঁয়ায়’। সেদিনের যুবকরা আজ বৃদ্ধ। ফিরে গেলেন তাঁরা তাঁদের যৌবনে।
বিখ্যাত সংগীতকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা এবং বিখ্যাত সুরকার সুপর্ণকান্তি ঘোষের সুরে গান করা যে ভাগ্যের ব্যাপার সে কথা স্মরণ করে সমদীপ্তা গাইলেন ‘তুমি বললে নিজেকে সমর্পণ করো’। তার পর পরিবেশন করলেন গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত রাগাশ্রয়ী গান ‘মায়াবতী মেঘে এল তন্দ্রা’। সমদীপ্তা বুঝিয়ে দিলেন রাগাশ্রয়ী গানেও তিনি সমান পারদর্শী।
আজকাল লোকসংগীত ছাড়া যে গানের আসর ঠিক জমে না, সেটা ভালোই বোঝেন সমদীপ্তা। তাই এ বার ধরলেন ‘ছাতা ধরো হে দেওরা, হেসান সুন্দর খোঁপা আমার ভিগ গিলাই না’। এবং তার পরে দুটি গানের ফিউশন – ‘পিন্দারের পলাশের বন’-এর সঙ্গে বাংলাদেশের ‘জলের গান’ ব্যান্ডের ‘এমন যদি হত, আমি পাখির মতো, উড়ে উড়ে বেড়াই সারাক্ষণ’। জমে গেল আসর।
সমদীপ্তা জানালেন, তাঁর বাবা জগজিৎ সিংয়ের গজলের খুব ভক্ত ছিলেন। আর সেই বাবার সূত্রে সমদীপ্তাও একই রসের রসিক। শোনালেন জগজিৎ-এর তিনটি বিখ্যাত গান একটু একটু করে – ‘তুম ইতনা যো মুস্করা রহে হো/কয়া গম হ্যায় জিসকো ছুপা রহে হো’, ‘তুমকো দেখা তো ইয়ে খয়াল আয়া’ এবং ‘হোটোঁ সে ঝুলো তুম মেরা গীত অমর কর দো’। শ্রোতা-দর্শককুলের মন ছুঁয়ে গেল এই পরিবেশনা।
এর পরেই সমদীপ্তার কণ্ঠে শ্রোতা-দর্শকরা ফিরে পেলেন তাঁদের অতি প্রিয় শিল্পী সদ্য প্রয়াত নির্মলা মিশ্রকে তাঁর সেই বিখ্যাত গান ‘এমন একটি ঝিনুক খুঁজে পেলাম না, যাতে মুক্তো আছে’-র মধ্য দিয়ে। এর পর সমদীপ্তার পরিবেশনা ‘শোর’ ফিল্মে লক্ষ্মীকান্ত প্যারেলালের সুরে লতা ও মুকেশের গাওয়া সেই দ্বৈত সংগীত ‘এক পেয়ার কা নগমা হ্যায়’। বহুল জনপ্রিয় এই গানটির পরিবেশনার সময়ে সমদীপ্তার সঙ্গে গলা মেলালেন শ্রোতা-দর্শকরাও।
কোনো সংগীতের আসরে আমাদের সকলের প্রিয় রবীন্দ্রনাথকে কি দূরে রাখা যায়? সমদীপ্তা কবিগুরুর প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন ‘আকাশ আমায় ভরল আলোয়, আকাশ আমি ভরব গানে’র মাধ্যমে।
সংগীত পরিবেশনার ফাঁকে সমদীপ্তা জানালেন, সুরসম্রাট ইলায়ারাজার কাছ থেকে ডাক পেয়েছেন তিনি। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সমদীপ্তা পরিবেশন করলেন ইলায়ারাজার সুর করা গুলজারের লেখা সুরেশ ওয়াড়করের গাওয়া ‘সদমা’ ছবির গান ‘ইয়ে জিন্দগি গলে লগা লে’। তার পর সমদীপ্তার কণ্ঠে দুটি গানের ফিউশন – ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র সেই বিখ্যাত গান ‘ভেবে দেখেছ কি, তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে’ এবং ‘লাইফ ইন আ মেট্রো’ ছবিতে জেমস-এর গাওয়া ‘না জানে কোই/ক্যায়সী হ্যায় ইয়ে জিন্দগানী, জিন্দগানী/‘হমারি অধুরি কহানি’। অনবদ্য পরিবেশনা।
সবশেষে জমজমাট আসর। সবাইকে নাচে মাতিয়ে দিলেন সমদীপ্তা। পরিবেশন হল একেবারে হৃদয় থেকে – ‘দিল সে’, শাহরুখ খানের হিট। গুলজারের লেখা, এ আর রহমানের সুর করা আর সুখবিন্দর সিং এবং স্বপ্না অবস্থীর গাওয়া ‘চল ছাইয়া ছাইয়া’।
‘সমদীপ্তার’র প্রায় ঘণ্টাদেড়েকের পরিবেশনায় শ্রোতা-দর্শকরা এককথায় মোহিত, মুগ্ধ। তাঁরা অনেক দিন মনে রাখবেন এই সন্ধ্যার কথা।
ছবি: মৃত্যুঞ্জয় রায়