বইয়ের সেবাশুশ্রূষা রুটিন চেক-আপের মতো দরকার। ধুলো ঝাড়া, মলাট দেওয়া জীবনদায়ী ওষুধের কাজ সারে। উপরি লাভ কিছু পাতা পড়ে ফেলা।… লিখলেন অরুণাভ গুপ্ত।
আজাদ হিন্দ ফৌজ বা ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’, সংক্ষেপে আইএনএ (INA) বা ভারতীয় মুক্তি ফৌজ গঠনের মূলে ছিলেন রাসবিহারী বসু। পরে সুভাষচন্দ্র বসু (Subhas Chandra Bose) একে সাজিয়ে গুছিয়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে কাজে লাগান।
আবার তথ্য এটাও জানাল – ব্যাঙ্কক সম্মেলনের সময় ভারতে তখন জোরদার বিক্ষোভ ও চড়া উত্তেজনার আবহাওয়া, ‘ভারত ছাড়ো’ আওয়াজে জনগণ উত্তাল। আগুনে ঘি ঢালল ১৯৪২-এর আগস্ট হাঙ্গামা। সেই গনগনে মুহূর্তে মোহন সিং তাঁর অধীনস্থ সেপাই ও অফিসারদের নিয়ে ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন আজাদ হিন্দ ফৌজ। এই বাহিনী গড়ার মূলে ছিল নিখাদ দেশপ্রেম। ঘটনা হল মোহন সিং ব্রিটিশ রাজের অধীনে ক্যাপ্টেন ছিলেন। ১৯৪৩-এর ১৩ ফেব্রুয়ারির পর আবার ধাপে ধাপে আজাদ হিন্দ বাহিনী ঢেলে সাজা কাজ পুরোদমে শুরু হয়।
আজাদ হিন্দ ফৌজ গড়ার নেপথ্যে কোন রাজনৈতিক কারণগুলি কাজ করেছে? পশ্চিমী সভ্যতার প্রভাবে ধারণা জন্মায় যে, পাশ্চাত্যের সংস্পর্শের দরুন পিছিয়ে থাকা প্রাচ্যের কল্যাণ অবধারিত। ভারতবর্ষ তখন রীতিমতো পিছিয়ে, দুর্ভিক্ষ-মহামারির লাগাতার আক্রমণে দেশের মানুষ জর্জরিত। স্বেচ্ছাচারী নিষ্ঠুর শাসকদের কবলে পরাধীন, অর্থনীতি আর প্রশাসনে চূড়ান্ত অরাজকতা। অবিশ্বাসের ভিত তৈরি হল। উনিশ শতকের শেষ ১০ বছরে আবার গা ঝাড়া দিয়ে ওঠা ও বিশ শতকের প্রথম ১০ বছরে এবং পঞ্জাবে অগ্নি-মন্ত্রে দীক্ষিত বিপ্লবীদের উদ্ভব ঘটে। রাজনৈতিক ব্যর্থতাবোধ আর একটি কারণ ছিল। ইংল্যান্ড তার বিধিবিধান, সভ্যতা, সংস্কৃতি সব দিলেও দেয়নি তার সমাজ। ভারতবর্ষ স্বায়ত্তশাসনের অধিকারী হবে, এ কথা মেনে নেওয়ার পাশাপাশি ব্রিটিশের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি পর্যন্ত দেওয়া হয়। কিন্তু সিপাহি বিদ্রোহের ফলে যে অনুচিন্তা এবং ভিক্টোরিয়ার আমলে যে বিশাল সাম্রাজ্যবাদী জাঁকজমক দেখা গেল, তাতে প্রতিশ্রুতি নামেই রইল।
সুভাষচন্দ্র ১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবর সিঙ্গাপুরে জাপ সরকারের অনুমোদন ও সহায়তায় আজাদ হিন্দ সরকার স্থাপন করলেন, হলেন প্রধান পুরুষ। আজাদ হিন্দ ফৌজের মধ্যে ভারতের সব প্রদেশের লোক ছিলেন। বেসরকারি বিবরণীতে পাওয়া যায়, এই ফৌজে ১৪ জন অফিসার এবং ৫০ হাজার সৈন্য ছিলেন। ফৌজে তৈরি হল পদ অনুযায়ী তকমা বা চিহ্ন অথবা ব্যাজ। যেমন ‘আইএনএ শোল্ডার ইনসিগনিয়া’- জেনারেল, লেফটেন্যান্ট জেনারেল, মেজর জেনারেল, কর্নেল, লেফটেন্যান্ট কর্নেল, মেজর, ক্যাপ্টেন, ফার্স্ট লেফটেন্যান্ট, সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট, সাব-অফিসার, হাবিলদার, নায়েক, লান্স নায়েক।
তবে আইএনএ সম্পর্কে জাপবাহিনী জেনারেল ফুজিহারা-র মন্তব্য ছিল – “বিপ্লবী সৈন্যদল হিসেবে এর মনোভাব ভালো ছিল এবং বেশ সুসংগঠিত ছিল, কিন্তু এর রণকৌশল, শিক্ষা ও নেতৃত্ব ছিল নিচু স্তরের।… তা ছাড়া বিশেষ ভাবে অভাব ছিল আক্রমণ ক্ষমতার ও দৃঢ়তার”।
আবার ফুজিহারা এ-ও স্বীকার করেছেন, প্যালেলসরকে জাপবাহিনী ধরাশায়ী হলেও অবস্থা সঙ্গীন হয়ে পড়ত, সেই সময় দ্বিতীয় এবং তৃতীয় আইএনএ রেজিমেন্টের সাহায্য পাওয়ায় তার পক্ষে দাঁড়িয়ে যুঝতে পারা সম্ভব হয়েছে। ঘটনাপ্রসঙ্গে জেনে রাখা দরকার আইএনএ যখন লড়াই করছে, তখন তার না আছে বেতারযন্ত্র, না আছে টেলিফোন, না আছে যানবাহন। হালকা মেশিনগান ছাড়া আর কোনো ভারী অস্ত্রই নেই। জাপানি আর ব্রিটিশ-ভারতীয়দের পরণে থাকত জঙ্গলে গা-ঢাকা দেওয়ার মতো সবুজ উর্দি, কিন্তু আইএনএ সৈন্যের ছিল সে দিক দিয়ে মার্কামারা – তাদের পরণে ব্রিটিশ খাকি।
নজরে এল, যে আজাদ হিন্দ ফৌজকে সেরা স্বাধীনতাকর্মীদের নিয়ে গড়া একটি হিরের টুকরো দল বলে ভাবা হয়েছিল, আসলে দেখা গেল তাতে এলোপাথাড়ি জোটানো হয়েছে যত সব নিকৃষ্ট কারিগর। এতে কাজ হবে না। সুভাষ সব বুঝলেন, আজাদ হিন্দ ফৌজকে ‘গড়তে হবে জার্মানির এস-এস দল অথবা রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির কায়দায়। চুক্তি হল: আজাদ হিন্দ ফৌজ জাপানি সামরিক আইনের আওতার মধ্যে পড়বে না, নিজস্ব সামরিক বিধি তারা মানবে। সত্য হল, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের ২০টি রেজিমেন্টের লোক নিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠিত। ফলে একটা জগাখিচুড়ির অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা ভিন্ন ভাষাভাষী। যে সৈন্যবাহিনী থেকে তাঁরা এসেছেন, তার বিরুদ্ধে নতুন নেতৃত্বের অধীনে নতুন ভাবধারা নিয়ে তাঁদের লড়াই করতে শিখতে সময় লাগবে।
তবে শুদ্ধিকরণ হওয়ার পর আজাদ হিন্দ ফৌজের সদস্যদের নতুন করে শপথ নিতে হবে যে, “আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে যাব।…সাময়িক ভাবে যদি হেরে যেতেই হয়, জাতীয় ত্রিবর্ণ পতাকা উঁচু করে লড়তে লড়তে হেরে যাও, পরাজিত হও। তোমাদের বিরাট আত্মত্যাগের ফলেই ভারতীয়দের ভাবী বংশধরেরা ক্রীতদাস হিসেবে নয়, স্বাধীন মানুষ হিসেবে জন্ম নেবে।… ভারত স্বাধীন হবেই- সে দিন দূরে নয়” – ‘মাই মেমারিজ অব দ্য আইএনএ অ্যান্ড ইটস নেতাজি’, শাহনওয়াজ। ভারত অভিযানে আজাদ হিন্দ ফৌজ আগাগোড়া আক্রমণের পুরোভাগে থাকে।”যেন ভারতের মাটিতে আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈনিকেরই প্রথম রক্তবিন্দু পড়ে।”
ঋণস্বীকার: ব্র্যাঘ্রকেতন/সুভাষ মুখোপাধ্যায়, ভারতের জাতীয় আন্দোলন/ প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, বরণীয়/যোগেশচন্দ্র বাগল,Transfer of Power (1942-7), Volume VI.