ভারত ও বাংলাদেশ একে অপরের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় দুই দেশের মধ্যে ভালো সম্পর্ক রাখা ছাড়া বাংলাদেশের অন্য কোনো পথ নেই। তবে কিছু “অপপ্রচারের” কারণে সম্পর্কের মাঝে কিছু মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। এমনটাই মতামত জানালেন বাংলাদেশের উপদেষ্টা সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস।
সোমবার বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে, তা দূর করার চেষ্টা চলছে। তিনি অপপ্রচারের উৎস সম্পর্কে কিছু জানাননি। তার এই মন্তব্য এমন এক সময়ে এসেছে, যখন আগামী ৩-৪ এপ্রিল থাইল্যান্ডে বিমসটেক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ওই সম্মেলনের ফাঁকে ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে বৈঠকের উদ্যোগ নিতে আগ্রহী।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে “খুব ভালো” আখ্যা দিয়ে ইউনূস বলেন, “আমাদের সম্পর্কে কোনো অবনতি হয়নি এবং এটি সবসময় ভালো থাকবে। এখন ভালো আছে, ভবিষ্যতেও ভালো থাকবে। ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখা ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ, আমরা একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে আমরা এতটাই সংযুক্ত যে, আমাদের বিচ্ছিন্ন থাকার সুযোগ নেই। তবে কিছু অপপ্রচারের কারণে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে। কারা এই অপপ্রচার চালাচ্ছে, সেটা অন্যরা বিচার করবেন। তবে এর ফলে আমাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে, যা আমরা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি।”
ইউনূস জানান, দুই দেশের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে এবং উচ্চ পর্যায়ের সফরও অব্যাহত রয়েছে। তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গেও কথা বলেছেন বলে উল্লেখ করেন।
গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর থেকে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয়। এরপর নোবেল বিজয়ী ইউনূসের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। ভারতের পক্ষ থেকে বারবার বাংলাদেশে হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা করা হয়েছে।
এই সম্পর্কের অবনতি বাণিজ্য, ভিসা নীতি ও জনসংযোগের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে, বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ভারতের ভিসা প্রক্রিয়ায় জটিলতা তৈরি হয়েছে। ভারত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বেশ কয়েকজন নেতার বক্তব্য এবং সম্প্রতি একদল উগ্রপন্থীর হাতে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানের পৈতৃক বাড়ি ধ্বংসের ঘটনায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।
এদিকে, বাংলাদেশ সরকার ভারতে স্বেচ্ছানির্বাসনে থাকা শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ দাবি করেছে এবং তাঁকে কোনো প্রকাশ্য বক্তব্য রাখার সুযোগ না দেওয়ার জন্য ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
বাংলাদেশ সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সম্প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কলহ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে, ইউনূস সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য দায়ী করেন।
ইউনূস বলেন, “এটি তাঁর (জামানের) মন্তব্য, তিনি বলতে পারেন। কিন্তু আমি এটি সমর্থন করব কি না, তা বলা আমার কাজ নয়। অস্থিরতা সৃষ্টির আশঙ্কা সবসময়ই থাকে। একটি দল দেশ ছেড়ে পালিয়েছে, তাদের নেতৃত্ব চলে গেছে। তারা দেশকে অশান্ত করার চেষ্টা করছে”।
তিনি আরও বলেন, “এটি সবসময়ই একটি হুমকি, এবং তা সর্বদা থাকবে। তাদের নেতারা যেসব বক্তব্য দিচ্ছেন, তাতে মানুষ আরও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে।”
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে ইউনূস পুনরায় আশ্বস্ত করেছেন যে, এই বছরের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দলগুলোর উপর নির্ভর করবে বলে তিনি জানান।
ইউনূস বলেন, “সব রাজনৈতিক দল যা সিদ্ধান্ত নেবে, আমি সেটিই করব… যারা অন্যায় করেছে, তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে”।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অপরিবর্তিত রয়েছে। বিএনপির নেতা তারেক রহমানের “তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিরপেক্ষ নয়”—এই মন্তব্যও তিনি নাকচ করে দেন। ইউনূস জানান, ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের দ্বারা গঠিত নতুন রাজনৈতিক দলকে সরকার কোনোভাবে সহায়তা করছে না।
ইউনূস বলেন, “সরকার তাদের কোনো সাহায্য করছে না। তিনজন ছাত্র প্রতিনিধি সরকারের অংশ ছিলেন, তাঁরা পদত্যাগ করে চলে গেছেন”।