ইরান জুড়ে চরম জলসংকট। দীর্ঘ খরায় শুকিয়ে যাচ্ছে দেশের প্রধান জলাধারগুলি, আর রাজধানী তেহরান প্রায় জলশূন্য অবস্থায় দাঁড়িয়ে। বৃষ্টিপাতের অভাবে শুষ্ক হয়ে পড়েছে নদী, ড্যাম ও ভূগর্ভস্থ জলস্তর। সরকার আশঙ্কা করছে, যদি দ্রুত বৃষ্টি না হয়, তবে রাজধানীতে জলর রেশনিং শুরু করতে হতে পারে।
রবিবার প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান সতর্ক করে বলেন, “যদি রেশনিংয়েও সমাধান না আসে, আমাদের তেহরান খালি করার কথাও ভাবতে হতে পারে।”
তাঁর এই মন্তব্যে ইতিমধ্যেই ইরানের সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। তেহরানের প্রাক্তন মেয়র ঘোলামহোসেইন কারবাসচি একে “একটি রসিকতা” বলে ব্যঙ্গ করেছেন।
রেকর্ড কম বৃষ্টিপাত ও শুকনো জলাধার
ইরানের আবহাওয়া দফতরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের তুলনায় এ বছর বৃষ্টিপাত ৯২ শতাংশ কমেছে। তেহরানের প্রধান দুটি জলাধার—লাতিয়ান ড্যাম ও করাজ ড্যাম—এখন প্রায় খালি।
লাতিয়ান ড্যামের এক আধিকারিক জানান, “বর্তমানে ড্যামের মোট ক্ষমতার ১০ শতাংশেরও কম জল রয়েছে।”
করাজ ড্যামের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ-আলি মোয়াল্লেম বলেন, “আমাদের রিজার্ভে মাত্র ৮ শতাংশ জল অবশিষ্ট আছে, যার বেশিরভাগই ‘ডেড ওয়াটার’—ব্যবহারের অযোগ্য।”

তেহরানে জলসংকটে নিত্যজীবন বিপর্যস্ত
তেহরানের বহু এলাকায় দিনরাত জল সরবরাহ বন্ধ থাকছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এক মহিলা স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, “আমি এখন জলর ট্যাঙ্কার কিনতে বাধ্য হচ্ছি, যাতে অন্তত টয়লেট ব্যবহারে সুবিধা হয়।”
একইভাবে, জনপ্রিয় র্যাপার ভাফা আহমদপুর একটি ভিডিও পোস্ট করে দেখান, “চার-পাঁচ ঘণ্টা ধরে আমাদের রান্নাঘরের কল শুকনো। বোতলজাত জল কিনে টয়লেট ব্যবহার করতে হচ্ছে।”
ইরানের জ্বালানি মন্ত্রী আব্বাস আলি আবাদি জানিয়েছেন, “পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে কিছু রাতে জলের সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ রাখতে হতে পারে।”
লিকেজ, পরিকাঠামোগত সমস্যা ও যুদ্ধের প্রভাব
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, তেহরানের পুরনো জলবন্টন ব্যবস্থায় শতাধিক ফাটল ও লিকেজ রয়েছে, যার কারণে বিশাল পরিমাণ জল অপচয় হচ্ছে। আবাদি আরও দাবি করেছেন, সম্প্রতি ইজরায়েল সঙ্গে ১২ দিনের যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাজধানীর কিছু জল সরবরাহ নেটওয়ার্ক।
১৫ জুন তেহরানের তাজরিশ অঞ্চলে ইসরায়েলি হামলার পর সেখানে আকস্মিক বন্যার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। ইসরায়েল জানিয়েছিল, তারা “ইরানের সামরিক কমান্ড সেন্টার” লক্ষ্য করে আক্রমণ চালিয়েছে।
🚨🇮🇷 IRAN WATER CRISIS
— Chyno News (@ChynoNews) November 6, 2025
Iran is facing the worst water shortage in a decade after years of severe drought
Authorities warn Tehran's water supply may only last weeks
A recent time-lapse from satellite images shows the droughts effect on Lake Urmia, which is at risk of drying up https://t.co/J1e9BrRjok pic.twitter.com/JrBBo22uo8
দেশজুড়ে ভয়াবহ জলসংকট
তেহরানই নয়, ইরানের অন্যান্য প্রদেশগুলিতেও একই পরিস্থিতি। দেশের ন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট অ্যান্ড ড্রট ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট জানিয়েছে, পশ্চিম আজারবাইজান, পূর্ব আজারবাইজান ও মার্কাজি প্রদেশের ড্যামগুলিও এখন “অত্যন্ত উদ্বেগজনক অবস্থায়”।
উত্তর-পূর্ব ইরানের মাশহাদ শহরেও বিপদ ঘনাচ্ছে। প্রাদেশিক গভর্নর জানান,“আমাদের ড্যামগুলির জলর পরিমাণ ৮ শতাংশেরও কমে নেমেছে—আমরা এক ‘মেগা খরার’ মুখে।”
মাশহাদের জল সরবরাহ সংস্থার প্রধান হোসেইন এসমাইলিয়ান আরও আশঙ্কাজনক তথ্য দেন, “মাশহাদের চারটি জলাধারের সম্মিলিত ক্ষমতার মাত্র ৩ শতাংশ জল অবশিষ্ট আছে। তিনটি ড্যাম ইতিমধ্যেই কার্যত বন্ধ।”
দশকের পুরনো সংকটের পরিণতি
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইরানের এই জলসংকট হঠাৎ নয়—দশকের পর দশক ধরে অদূরদর্শী পরিকল্পনা ও জলসম্পদ অপব্যবহারের ফলেই এই অবস্থা। এমনকি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ আলি খামেনেই-ও বহুবার জল সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি সরকার।
আজ তেহরান, করাজ এবং মাশহাদ—মোট ১.৬ কোটি মানুষের শহর—বাস্তবিক অর্থে জলশূন্যতার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে।


