ভারতীয় আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের নীচে মেয়ে এবং ২১ বছরের কম বয়সি ছেলের বিয়েকে বাল্যবিবাহ আখ্যা দেওয়া হয়। অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে রোধ করতে নেওয়া হয় বহুবিধ পদক্ষেপ। তা সত্ত্বেও ভারতে বাল্যবিবাহের সংখ্যা মোটের উপর কম নয়। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের নানা প্রকল্প সত্ত্বেও এই পরিসংখ্যানে তেমন কোনো পরিবর্তনও আসেনি বলে মত সমীক্ষকদের।
ভারতে বাল্যবিবাহ
ভারতে বাল্যবিবাহের সমস্যা গুরুতর। বিশ্বের মোট বাল্যবিবাহের ৪০ শতাংশেরও বেশি শুধুমাত্র ভারতে হয়। এখানে প্রায় অর্ধেক মেয়ের বিয়ে হয় ১৮ বছর বয়সের কম। তবে শেষ কয়েক দশকে বাল্যবিবাহের সমস্যা কমেছে। ১৯৯৩ সালে, ৪৯ মেয়ের অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল, সেখানে ২০২১ সালে এই সংখ্যা ২২ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে, এই পরিসংখ্যান নিম্নমুখী হলেও সমস্যা কিন্তু গুরুতর আকারেই রয়ে গিয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১ সালে প্রায় ১ কোটি ৩৫ লক্ষ মেয়ে এবং ১৪ লক্ষ ছেলে বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে।
এখনও দেশের প্রায় চার-পাঁচটি রাজ্যে দেশের অর্ধেকেরও বেশি বাল্যবিবাহ হয়ে চলেছে। এই রাজ্যগুলির মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে বিহার, ঝাড়খণ্ড, রাজস্থান এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্য। নতুন করে বলার নয়, শহরের তুলনায় গ্রামে বাল্যবিবাহের সমস্যা বেশি। ১৮ বছরের আগে বিয়ের পরিসংখ্যান অনুয়ায়ী, শহরে যেখানে এই হার ২৯ শতাংশ, গ্রামে সেটাই ২৬ শতাংশ। অর্থাৎ, শহরের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হারে বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটছে গ্রামাঞ্চলে।
যে রাজ্যে বাল্যবিবাহের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি
দ্য ল্যানসেট গ্লোবাল হেলথ জার্নাল ১৯০৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পাঁচবার (১৯৯৩, ১৯৯৯, ২০০৬, ২০১৬, ২০২১) পরিচালিত ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে (NFHS)-এর তথ্যের উপর ভিত্তি করে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। হিসেব অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাল্যবিবাহের শিকার হওয়া মেয়ের সংখ্যা ছিল আনুমানিক ১ কোটি ৩৪ লক্ষ ৬৪ হাজার ৪৫০ জন, যেখানে ছেলের সংখ্যা ছিল আনুমানিক ১৪ লক্ষ ৫৪ হাজার ৮৯৪ জন।
মেয়েদের বাল্যবিবাহের মোট পরিসংখ্যানের অর্ধেকেরও বেশি মাত্র চারটি রাজ্যেই। বিহার (১৬.৭ শতাংশ), পশ্চিমবঙ্গ (১৫.২ শতাংশ), উত্তরপ্রদেশ (১২.৫ শতাংশ) এবং মহারাষ্ট্র (৮.২ শতাংশ)। যেখানে ছেলেদের ক্ষেত্রে, এই পরিসংখ্যানগুলি গুজরাত (২৯.০ শতাংশ), বিহার (১৬.৫ শতাংশ), পশ্চিমবঙ্গ (১২.৯ শতাংশ) এবং উত্তরপ্রদেশে (৮.২ শতাংশ) সবচেয়ে বেশি।
সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে বাল্যবিবাহের ঘটনা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। ২০২১ সালে এখানে ৫ লক্ষেরও বেশি মেয়ের বাল্যবিবাহ হয়েছিল। যদি শতাংশের দিক থেকে দেখা যায়, ঝাড়খণ্ডে সর্বোচ্চ ৫৩.১ শতাংশ বৃদ্ধি দেখা গেছে।
কোন ধর্মে মেয়েদের বাল্যবিবাহ সবচেয়ে বেশি?
পরিসংখ্যান বলছে, যে কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি তিনজন বিবাহিত মহিলার মধ্যে একজনের ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে হয়ে যায়। সর্বাধিক ৩১.৩ শতাংশ হিন্দু মহিলা এবং তারপর ৩০.৬ শতাংশ মুসলিম মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাত্রীর বয়স ১০ বছরও হয়নি।
২০১১ সালের আদমসুমারি রিপোর্ট অনুযায়ী, শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ এবং জৈন মহিলাদের বাল্য়বিবাহ সংখ্যা কম ছিল। মাত্র ৬ শতাংশ পুরুষের ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে হয়েছিল। সমস্ত হিন্দু মহিলার ৬ শতাংশ ১০ বছর বয়সের আগে বিয়ে হয়েছিল।
অসম সরকারের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ
বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ করার জন্য মুসলিম বিবাহ এবং বিবাহবিচ্ছেদ সংক্রান্ত ১৯৩৫ সালের আইন বাতিল করে দিয়েছে অসম সরকার। মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীসভা ২৩ ফেব্রুয়ারি এই সিদ্ধান্ত নেয়। যা ইউনিফর্ম সিভিল কোডের (ইউসিসি) দিকে এটি একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে ধরে নেওয়া হচ্ছে।
অসম মুসলিম বিবাহ এবং বিবাহবিচ্ছেদ নিবন্ধন আইন ১৯৩৫ ব্রিটিশ আমলে প্রণীত হয়েছিল। এই আইনের অধীনে, মুসলিমরা তাদের ইচ্ছানুযায়ী নিজস্ব বিবাহ এবং তালাক নিবন্ধন করতে পারে। রাজ্য সরকার মুসলমানদের বিয়ে ও তালাক নিবন্ধনের ছাড়পত্র দিত।
এখন অসম সরকারে সেই আইন প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর কোনো মুসলিম ব্যক্তি নিজের ইচ্ছায় বিয়ে ও তালাকের জন্য নিবন্ধন করতে পারবেন না। সমস্ত বিবাহ এবং বিবাহবিচ্ছেদ বিশেষ বিবাহ আইনের অধীনে সংঘটিত হবে।
অসম সরকার জানিয়েছেস বাল্যবিবাহ একটি সামাজিক কুফল এবং এটি বন্ধ করা প্রয়োজন। সরকার আরও বলছে, নতুন আইন সব ধর্মের মানুষের জন্য সমান ভাবে প্রযোজ্য হবে। নতুন আইনে বাল্যবিবাহের শাস্তি দুই বছর থেকে বাড়িয়ে ১০ বছর করার বিধান থাকবে।
মেয়েদের বাল্যবিবাহের কারণ
সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা, শিক্ষার সীমিত সুযোগ, মেয়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করবে, এই সম্ভাবনা নিয়ে অভিভাবকদের ভীতি, বয়ঃসন্ধির মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য দুশ্চিন্তা, আর্থ-সামাজিক অবস্থার নানা দিক এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যা শুধু বাল্যবিবাহকে বাঁচিয়েই রাখে না, তাকে বাড়তেও সাহায্য করতে পারে। এ ছাড়া শিশুপাচার আড়াল করতেও বাল্যবিবাহ ঘটে থাকে।
আরও পড়ুন: লোকসভা ভোট ঘোষণা হওয়ার আগেই রাজ্যে আসতে পারে কেন্দ্রীয় বাহিনী