মহারাষ্ট্রের জঙ্গলে ঘেরা জনপদ গড়চিরোলি। আদিবাসী অধ্যুষিত গড়চিরোলির গ্রামে ঋতুমতী মেয়েদের ঋতুস্রাব চলার সময় বাড়িতে থাকার অনুমতি মেলে না। আদিবাসী মাদিয়া সম্প্রদায়ের মেয়েদের ঋতুস্রাবের সময় বাড়ি থেকে দূরে মাটির কূর্মঘরে থাকতে হয়। খড়ের ছাউনিওয়ালা মাটির সেসব ঘরে কোনো দরজা, জানলা থাকে না। একদিন ওই কূর্মঘরে সদ্যবিবাহিতা এক তরুণীকে বিষধর সাপ কামড়ায়। কিন্তু মেয়েটি ঋতুমতী থাকায় কুসংস্কারবশত কেউ মেয়েটিকে বিষপ্রতিরোধী ওষুধ না দেওয়ায় সেই তরুণী অকালে প্রাণ হারায়। এই ঘটনাই বিশেষ ভাবে নাড়া দিয়েছিল চিকিৎসক রানি বাংকে।
কে এই ডা. রানি বাং? আসুন, পরিচয় করে নেওয়া যাক। নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিবিএস-এর ছাত্রী ছিলেন মহারাষ্ট্রের চন্দ্রপুরের মেয়ে রানি চারি। সেখান থেকেই ১৯৭২-এ তিনি ডিগ্রি অর্জন করেন। তার পর ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ১৯৭৬-এ অবস্টেট্রিক্স-গায়নেকোলজিতে এমডি হন রানি। রানির সহপাঠী ছিলেন মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ধার ছেলে অভয় বাং। তিনিও এমবিবিএস হন ১৯৭২-এ এবং ১৯৭৭-এ মেডিসিনে এমডি হন। দু’জনেই স্নাতকোত্তর স্তরে স্বর্ণপদক পেয়ে শীর্ষ স্থানাধিকার করেন। ১৯৭৭-এ রানি ও অভয়ের বিবাহ হয়।
ডাক্তারি করার জন্য এই চিকিৎসকদম্পতি চলে যান ওয়ার্ধা জেলার একটি গ্রামে। সেখানে তাঁরা ‘চেতনা বিকাশ’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গড়ে তোলেন। তার পর তাঁরা জনস্বাস্থ্যে স্নাতকোত্তর করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোরে জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। ১৯৮৪ সালে জনস্বাস্থ্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। দেশে ফিরে আসার পর দু’জনেই গান্ধীবাদী নীতি অনুসরণ করে গড়চিরোলির গ্রামে গরিব আদিবাসীদের মধ্যে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই উদ্দেশ্যেই ১৯৮৫ সালে দু’জনে মিলে গড়ে তোলেন ‘সার্চ’ (Society for Education, Action and Research in Community Health, SEARCH)। গড়চিরোলির আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামে জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ শুরু করেন রানি ও অভয়।

স্বামী অভয় বাং-এর সঙ্গে। ছবি The Better India ‘X’ থেকে নেওয়া।
সেইসময়েই কূর্মঘরে সাপের কামড়ে সদ্যবিবাহিতা তরুণীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। বিচলিত রানি আদিবাসীদের সঙ্গে কথা বলে কূর্মঘরের ব্যাপারটা জানতে পারেন। তিনি জানতে পারেন, ঋতুস্রাব চলার সময় ওই কূর্মঘরে একসঙ্গে অনেক মহিলা থাকেন। সে সময় কেউ তাঁদের স্পর্শ করতে পারে না। এমনকি মেয়েদের নিজেদেরই রান্না করে খেতে হয়। বাড়ি থেকে খাবার এলে তা ঘরের বাইরে রেখে দিতে হয়। রানি আরও অবাক হন যখন শোনেন ভয়েই হোক বা স্বেচ্ছায়ই হোক, মেয়েরাও এই অস্বাস্থ্যকর বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেয়। ঋতুমতী মেয়েদের সুস্থ জীবন দিতে বাং-দম্পতি আধুনিক সুবিধাযুক্ত কূর্মঘর গড়ে তোলেন।
গড়চিরোলির গ্রামের মানুষকে চিকিৎসা করার সময় চিকিৎসকদম্পতি দেখেন সেখানে প্রতি হাজার নবজাতকের মধ্যে মৃত্যুর হার হল ১২১। আর এই মৃত্যুর নানা কারণ রয়েছে। তার মধ্যে মূল কারণগুলি হল দারিদ্র্য, ডায়েরিয়া, সংক্রমণ, নিউমোনিয়া এবং হাসপাতালের অভাব। ধীরে ধীরে গড়চিরোলির গ্রামে আদিবাসী বান্ধব ক্লিনিক ও মা দন্তেশ্বরী নামে একটি হাসপাতাল গড়ে তোলেন বাং-দম্পতি।
বাং-দম্পতি ও ‘সার্চ’-এর সহকর্মীরা মিলে কীভাবে শিশুমৃত্যুহার কমানো যায় তা নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে গবেষণা চালান। সদ্যোজাত শিশুর যত্নে গ্রামীণ মহিলাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয় জোর দেওয়া হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে অসুখ চিহ্নিত করতে গ্রামীণ স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেন তাঁরা। বাং-দম্পতির তৈরি করা ‘হোম বেসড নিও ন্যাটাল কেয়ার’ (Home Based Neonatal Care, HBNC) মডেল অনুসরণ করে উল্লেখযোগ্য হারে গড়চিরোলির গ্রামে শিশুমৃত্যুর হার কমে। এতে পরবর্তী সময় সাড়া দেয় গোটা বিশ্বই। এই মডেলকে স্বীকৃতি দেয় হু এবং ইউনিসেফও।
ঋতুমতী মেয়েদের জন্য আগেকার কূর্মঘর। ছবি The Better India ‘X’ থেকে নেওয়া।
বাং-দম্পতির পদ্ধতি নিয়ে প্রথমদিকে সংশয় থাকলেও পরে তা অনুসরণ করতে শুরু করেন ভারতের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞরা। বাং-দম্পতির সফল প্রকল্প অনুসরণ করেই ভারতে জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের অধীনে ৮ লক্ষ আশাকর্মী নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্র। দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
শুধু শিশুমৃত্যুর হার কমানোই নয়, গড়চিরোলির গ্রামে মদ নিষিদ্ধ করার ব্যাপারেও উদ্যোগী হন বাং-দম্পতি। তাঁরাই গ্রামবাসীদের মদ্যপানের খারাপ দিক সম্পর্কে সজাগ ও সতর্ক করে তোলেন। ১৯৯০ সালে অভয় ও রানি বাং-এর উদ্যোগে মদ নিষিদ্ধ করার অভিযান শুরু হয় গড়চিরোলিতে। ১৯৯২ সালে আম জনতার দাবির কাছে নতিস্বীকার করে মহারাষ্ট্রের গড়চিরোলিতে মদ নিষিদ্ধ করা হয়। গড়চিরোলিই প্রথম জেলা যেখানে মদ নিষিদ্ধ করা হয়। এ ছাড়াও জঙ্গল অধ্যুষিত গড়চিরোলিতে ম্যালেরিয়া দমনে বিশেষ উদ্যোগ নেন বাং-দম্পতি। বিশ্বে রানি বাংই প্রথম চিকিৎসক যিনি গ্রামীণ মহিলাদের মধ্যে স্ত্রীরোগের সমস্যা নিয়ে গবেষণা চালান।
রানি বাং এবং অভয় বাং দু’জনেই পদ্মশ্রী সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন। দেশ-বিদেশের ৭২টি পুরস্কার পেয়েছেন তাঁরা। তাঁরাই প্রথম যাঁরা জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বিভাগের ডিসটিঙ্গুইশড অ্যালুমনাস সম্মান পেয়েছেন। ২০১৬ সালে তাঁরা এই পুরস্কার পান। এ ছাড়াও আইসিএমআরের মহাত্মা গান্ধী পুরস্কার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) পাবলিক হেলথ চ্যাম্পিয়ন পুরস্কার পেয়েছেন তাঁরা।