অরুণাভ গুপ্ত
বিশ্বযুদ্ধ শেষ হল। আজাদ হিন্দ ফৌজ”’-এর কাহিনি তার আগে পর্যন্ত সামরিক গোপন খবর হিসাবে চাপা ছিল— এ বার সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে তা প্রকাশ পেল।
জওহরলাল নেহরু ২০ আগস্ট বিষয়টা উল্লেখ করে বললেন: ‘বর্তমানে “আজাদ হিন্দ ফৌজ”’-এর অফিসার ও সৈন্যদের বিরাট একটা অংশ… বন্দি হয়ে আছে এবং তাদের মধ্য অন্তত কিছু লোকের ফাঁসি হয়েছে। …যে কোনো সময়েই তাদের প্রতি অতিরিক্ত
কঠোর ব্যবহার করলে ভুল হতো, বিশেষ করে এখন— ভারতবর্ষে যখন অচিরে বড়ো রকমের পরিবর্তন ঘটবার কথা উঠেছে। তাদের সঙ্গে যদি সাধারণ বিদ্রোহীর মতো ব্যবহার করা হয় তা হলে অত্যন্ত গুরুতর রকমের ভুল করা হবে এবং তার ফল হবে সুদূরপ্রসারী। তাদের দণ্ডিত করার মানে হবে সারা ভারত এবং সমগ্র ভারতবাসীকে দণ্ডিত করা, কোটি-কোটি হৃদয় তার ফলে ক্ষতবিক্ষত হবে’।
সেপ্টেম্বরের শেষাশেষি লোকের মুখে ব্যাপক ভাবে “আজাদ হিন্দ ফৌজ”’-এর কথা ছড়িয়ে পড়ল। ‘…এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না যে, যে-সব পুরুষ ও নারী এই বাহিনীতে নাম লিখিয়েছিল … তারা একান্ত ভাবে চেয়েছিল ভারতের স্বাধীনতার পাদপদ্মে নিজেদের ঢেলে দিতে; এবং এও ঠিক যে, সামরিক আইনের কোনো সূত্র ধরে তাদের বেশ বড়ো একটা অংশকে যদি সাজা দেওয়া হয়, তা হলে ভারতের পক্ষে সেটা শোকাবহ ঘটনা হবে’। (ব্যাঘ্রকেতন, পৃ: ২৩১)
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর লিখিত গ্রন্থ ভারতে জাতীয় আন্দোলন-এ লিখেছেন: “আজাদ (হিন্দ) ফৌজ” ব্রিটিশ সৈন্যদের হস্তে বন্দি হইয়া বিচারের জন্য ভারতে প্রেরিত হইল।… ভারতের স্বাধীনতা লাভের জন্য সশস্ত্র আক্রমণ প্রয়াস ব্যর্থ হইল। তখন ব্রিটিশ রাজত্বের শেষ বৎসর— বিপ্লবীদের বিচার হইল। জবহরলাল (জওহরলাল) নেহরু ব্যারিস্টাররূপে “আজাদ হিন্দ ফৌজ”-এর রক্ষার জন্য আদালতে উপস্থিত হইলেন-ব্যারিস্টারি পাশ করিয়া আসিবার ত্রিশ বৎসর পর এই তাঁহার প্রথম আদালতে ওকালতি ও এই শেষ। ফৌজের বন্দিরা মুক্তিলাভ করিল’।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের আপসহীন বিপ্লবাত্মক ধারার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। তাঁর হার না মানা জেদের অন্তরালে ছিল দামাল স্বভাব বাঙালি ঐতিহ্য। যার উদাহরণ আইএনএ বন্দিদের প্রতি ব্যবহার সম্পর্কে বিবৃতি— ‘বর্মা থেকে বিশ্বস্ত সূত্রে আমরা খবর পেয়েছি যে, “আজাদ হিন্দ ফৌজ”-এর যে-সমন্ত অফিসার ও সৈনিক বর্মায় ইঙ্গ-মার্কিনদের হাতে ধরা পড়েছে, তাদের প্রতি নিষ্ঠুর ও প্রতিহিংসামূলক ব্যবহার করা হচ্ছে। দনিয়াসুদ্ধ সবাই জানে যে, ইঙ্গ-মার্কিনেরা— বিশেষত ব্রিটিশেরা— ইঙ্গ-মার্কিন যুদ্ধবন্দিদের উপর দুর্ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জার্মানি ও জাপানের ঘাড়ে সবসময় দোষ চাপিয়ে থাকে। কিন্তু আজ জিজ্ঞেস করতে চাই যে, বর্মায় “আজাদ হিন্দ ফৌজ”’-এর যে-সব লোকজন ধরা পড়েছে তাদের সঙ্গে ইঙ্গ-মার্কিনেরাই বা কী ধরনের আচরণ করেছে? বর্মায় মিত্রপক্ষে যদিও পাঁচ জাতের লোক আছে, তা হলেও “আজাদ হিন্দ ফৌজ”-এর লোকজনদের সঙ্গে দুর্ব্যহারের জন্যে একমাত্র দায়ী ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। ব্রিটিশের যে-সব সৈন্য আমাদের হাতে ধরা পড়েছিল, তাদের সঙ্গে আমরা খারাপ ব্যবহার করেছি, এ-কথা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের বানিয়ে বলবারও সাধ্য নেই। মিত্রপক্ষ থেকে যারা এসেছে তারা নিজে থেকে এসে আমাদের কাছে ধরা দিয়েছে এবং “আজাদ হিন্দ ফৌজ”-এ যোগ দিয়েছে। আর এমনকি দিল্লি বেতার পর্যন্ত দিন কয়েক আগে স্বীকার করেছে যে, “আজাদ হিন্দ ফৌজ”’-এ যারা যোগ দিয়েছে তারা সবাই ভালো ব্যবহার পেয়েছে’। (ব্যাঘ্রকেতন, পৃ: ২৮৮)