উজ্জ্বল বন্দ্যোপাধ্যায়, কুলতলি: সুন্দরবনে নাবালিকা বয়সে শিশুর জন্ম দেওয়ার সংখ্যা বেড়ে চলায় চিন্তায় প্রশাসন।
পুতুল খেলার বয়সেই মা, চিন্তা বাড়াচ্ছে তাই। বাড়ছে নাবালিকা অন্তঃসত্ত্বার সংখ্যা। বয়স মাত্র ১২। পুতুল খেলার বয়সেই সুন্দরবনের কুলতলির এক নাবালিকাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায়। নানান শারীরিক জটিলতা দেখে জয়নগর কুলতলি গ্রামীণ হাসপাতাল থেকে তাকে পাঠানো হয় বারুইপুর মহকুমা হাসপাতালে। সেখানে সন্তানের জন্ম দেয় সে।
গত মে মাসের এই ঘটনায় হাসপাতালের তরফে থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল।পুলিশ জানতে পারে, পাড়ারই কুড়ি বছরের এক যুবকের সঙ্গে মাস কয়েক আগে বিয়ে হয় ঐ নাবালিকার।আর এই ঘটনা বেড়ে চলেছে বলেই দাবি সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকায় কাজ করা চিকিৎসকদের। তাঁরা বলেন, গ্রামীণ হাসপাতালগুলিতে ১৮ বছরের কম বয়সিরা প্রায় প্রতিদিনই সন্তানের জন্ম দিচ্ছে। মাঝে মধ্যে কুলতলির ওই নাবালিকার মত আরও কম বয়সী মেয়ে ও মা হচ্ছে। এত কম বয়সে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ায় নানা রকম শারীরিক জটিলতা তৈরি হচ্ছে এদের। অনেক ক্ষেত্রে গর্ভপাতও হচ্ছে। রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ছে অনেকে।আর নাবালিকার বিয়ে আটকাতে রাজ্য জুড়ে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে প্রশাসন। কিন্তু তাতে যে কাজের কাজ হচ্ছে না, তাঁর প্রমাণ মিলছে প্রত্যন্ত এলাকার হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসায় আসা প্রসূতিদের তালিকাতেই।
জানা যায়, জয়নগর কুলতলির ব্লক গ্রামীণহাসপাতালে গত আর্থিক বছরে ৮৫৪ জন কুড়ি বছরের কম বয়সি (টিন এজার) কিশোরী মা হয়েছে। যা হাসপাতালে আসা মোট অন্তঃসত্ত্বার ১৮ শতাংশ।গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে,২০ বছরের নীচে এই অন্তঃসত্ত্বার সংখ্যা কুড়ি শতাংশের আশেপাশে। এদের অনেকেরই বয়স ১৮ বছরের কম। দক্ষিণ ২৪ পরগনার প্রত্যন্ত ব্লকগুলিতে সর্বত্রই পরিস্থিতি প্রায় একই বলেই দাবি চিকিৎসকদের। চিকিৎসকেরা বলেন, এক্ষেত্রে সরকারি পরিসংখ্যানই চমকে দেওয়ার মত। এর বাইরে একটা অংশ স্থানীয় বেসরকারি হাসপাতাল বা চিকিৎসাকেন্দ্রে চিকিৎসা করাচ্ছে। সেই হিসেব সবসময় সামনে আসছে না।
চিকিৎসকেরা বলছেন, এর পিছনে দায়ী অসচেতনতাই। নানা কর্মসূচি, আইনি পদক্ষেপেও নাবালিকা মেয়ের বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা আটকানো যাচ্ছে না। ইদানীং নাবালক-নাবালিকাদের মধ্যে অনিয়ন্ত্রিত যৌন সংসর্গের ঘটনা বেড়েছে। ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে।
স্থানীয় সূত্রের খবর,১৫-১৬ বছরের মেয়েরা বিয়ের আগেই অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ছে। ফলে তড়িঘড়ি বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাদের। কুলতলিতেই এমনই এক ঘটনা সামনে এসেছে সম্প্রতি। এলাকারই এক স্কুলের একাদশ শ্রেণির কৃতী এক ছাত্রী শারীরিক কিছু সমস্যা নিয়ে জয়নগর কুলতলি গ্রামীণ হাসপাতালে যায়।পরীক্ষা করে জানা যায়, সে তখন অন্তঃসত্ত্বা। এলাকার এক যুবকের সঙ্গে সম্পর্ক আছে বলে জানায় সে। দ্রুত বছর ষোলোর ওই ছাত্রীর বিয়ের আয়োজন হয়। স্কুলে প্রথম হওয়া ওই ছাত্রী বর্তমানে সন্তান প্রসবের অপেক্ষায়।
শারীরিক জটিলতা এড়াতে কুড়ি বছর বয়সের আগে মেয়েদের মা হওয়া উচিত নয় বলেই জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। প্রশাসনের তরফে গ্রামে গ্রামে এই বার্তা প্রচারও করা হচ্ছে। কমবয়সি দম্পতিদের নিয়ে বৈঠক,কাউন্সেলিং করা হচ্ছে। গর্ভ নিরোধক নানা উপায় সম্পর্কে জানানো হচ্ছে তাদের। কিন্তু ফল মিলছে কম ক্ষেত্রেই।
সুন্দরবনের এক গ্রামীণ হাসপাতালের কাউন্সেলিংয়ের দায়িত্বে থাকা এক চিকিৎসাকর্মীর কথায়,কম বয়সে বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা তো আছেই। বিয়ের পর দ্রুত বাচ্চা নিয়ে নিতে হবে, এমন প্রবণতাও কাজ করে।বাড়ির মা-কাকিমারাই এতে চাপ দেন। ইদানীং অনেক কম বয়সি ছেলে,এমনকী নাবালকদেরও বিয়ে হচ্ছে। মাতৃত্বকালীন শারীরিক জটিলতার কথা বা গর্ভ নিরোধকের গুরুত্ব এই বয়সের ছেলেমেয়েরা বুঝতে চায় না বলে এই ধরনের ঘটনা বেড়ে চলেছে।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার স্বাস্থ্য জেলার এক আধিকারিক বলেন, সুন্দরবনের গ্রামীণ এলাকায় অনেক নাবালিকা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ছে। এটা তো চিন্তার বটেই। আমরা আমাদের দিক থেকে চেষ্টা চালাচ্ছি। তবে এটা শুধু মাত্র স্বাস্থ্য দফতরের হাতে নেই। এটা এখন সামাজিক সমস্যা।বিভিন্ন দফতরের সমণ্বয়ে এর সমাধানের চেষ্টা করতে হবে।এব্যাপারে কুলতলি ব্লক প্রশাসন সূত্রে জানা গেল, নাবালিকা বিয়ের খবর আসলেই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।আর সচেতনতার প্রচারেও নানা কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে।তবে সাধারণ মানুষ আরো সচেতন না হলে এই ধরনের কাজ বেড়ে যাবে।