Home প্রবন্ধ দিনযাপনের গ্লানিতে যখন মন ভারাক্রান্ত, মনে পড়ে তাঁদের অশ্রুত কন্ঠস্বর

দিনযাপনের গ্লানিতে যখন মন ভারাক্রান্ত, মনে পড়ে তাঁদের অশ্রুত কন্ঠস্বর

0

উৎপল মণ্ডল

সে একসময় ছিল – ইলেকট্রনিক মিডিয়া বলতে দূরদর্শন। ৯০-এ পাড়ায় পাড়ায় দূরদর্শন। সেই বোকাবাক্সে খবর পড়তেন ছন্দা সেন। আশ্চর্য কণ্ঠস্বর। তিনি আলাদা ঘরানাই তৈরি করে ফেলেছিলেন। ১৯৭৪-এ আকাশবাণীতে সংবাদপাঠক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করার পর ১৯৭৫ থেকে কলকাতা দূরদর্শনে। সেখানকার নিয়মিত সংবাদপাঠক। রেডিওতে সেই সময়ের সময়ে আগে কিংবা পরে ছিলেন অমিয় চট্টোপাধ্যায় দিলীপ ঘোষ,পার্থ ঘোষ, গৌরী ঘোষ, শংকর ঘোষ, অজিত বসু প্রমুখ।

ছন্দা সেন হার্টের সমস্যায় এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। ছন্দা সেন জন্মেছিলেন এমন একসময়ে যখন সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না। তিনি প্রায় নীরবে চলে গেলেন। আজ সংবাদপাঠকরা যেন কসরত করেন, কোথায় সেই সংযত উচ্চারণ! খবরকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে তখনকার দিতে এক অদ্ভুত কৌশল ছিল। তখন খবরের এত চ্যানেল ছিল না। আকাশবাণী কলকাতাই ভরসা। সেসময় আকাশবাণী মাতিযে রাখছেন দিলীপ ঘোষ। তাঁর গম্ভীর গলায় যখন বন্দে মাতরম বলতেন, যখন মহালয়ার অধিবেশন শুরু করতেন, জানি না সেই কন্ঠস্বর কোথাও ধরা আছে কি না! দিলীপ ঘোষের একটাই আবৃত্তির বেকর্ড পাওয়া যায়। কর্ণকুন্তী সংবাদ, ১৯৭৫-এ বেরিয়েছিল। কুন্তীর ভূমিকায় কন্ঠ দিয়েছিলেন স্বয়ং অর্পণা সেন। বিশিষ্ট আবৃত্তিকার প্রদীপ ঘোষ অবশ্য বলেছিলেন ওই রেকর্ড বাজারে চলেনি। দিলীপ ঘোষকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শঙ্খ ঘোষ, নীরেন চক্রবর্তী এঁদের কবিতাও আবৃত্তি করতে দেখা যেত। আকাশবাণীও তাঁকে খুব কাজে লাগায়নি।

এদিক থেকে অনেকটাই ভাগ্যবান অমিয় চট্টোপাধ্যায়। তিনিও ঘোষক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু কবিতা বিভিন্ন লং প্লেয়িং রেকর্ডে পাওয়া যায়। ‘আবহমান বাংলা কবিতা’ নামক ক্যাসেটেও অমিয় চট্টোপাধ্যায়ের আবৃত্তি ছিল। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য জীবনানন্দের ‘নগ্ন নির্জন হাত’। গত শতাব্দীর শেষের দিকে নবদ্বীপের রাসমেলার ধারাবিবরণীও শোনা গিয়েছিল তাঁর গলায়। লম্বা, রোগা, নিপাট বাঙালি, পাজামা-পাঞ্জাবি পরতেন। খুব সিগারেট খেতেন কিন্তু গলা টসকাতে দেখিনি। একসময় সত্যিকারের লিটিল ম্যাগাজিন বার করতেন। আবৃত্তির ক্যাসেটও দেখিনি। কেউ ইউটিউবে আপলোডও করেনি। রবীন্দ্রনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ অমিয় চট্টোপাধ্যায় কন্ঠে অন্যরকম বার্তা এনে দেয়। শম্ভু মিত্রর পরে জীবনানন্দকে আমাদের সামনে এনে দেন অমিয় চট্টোপাধ্যায়। জীবনানন্দের ‘নগ্ন নির্জন হাত’ খুব জনপ্রিয়তা পায়নি কিন্তু রসিক লোকদের আনুকূল্য পেয়েছিল।

৭১-এর বাংলাদেশ হওয়ার আগে বেতারে তার অনুকূল ভূমি তৈরি করেছিলেন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রণবেশ সেন। প্রণবেশ খুব ছোট বাক্যে লিখতেন। হাতের অক্ষরও তেমন সুবিধার নয়, কিন্তু দেবদুলাল পড়তেন অসাধারণ। দেবদুলালের রেকর্ড বাজারে বেরিয়েছিল। সেগুলো এখন ইউটিউবে ঘোরে। এ ছাড়া বেশ কিছু গীতিনাট্য, রবীন্দ্রনাট্যেও গলা মিলিয়েছিলেন। কথায় বলে, ‘দেহপট সনে নট সকলি হারায়’। স্বপ্নময় চক্রবর্তী একবার বলেছিলেন, সবই তো ইথারে ভাসিয়ে দিলাম। সংবাদপাঠকদের, ঘোষক-ঘোষিকাদের আমরা কেউ মনে রাখিনি। দিল্লি থেকে খবর পড়তেন বিজন বোস, ইভা নাগ, নীলিমা সান্যাল, অনিল চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। এঁদের কন্ঠস্বরও আর খুঁজে পাওয়া যায় না। বরুণ হালদার বাঙালি হয়ে ইংরেজি নিউজ ৱুলেটিন পড়তেন। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর রেডিওয় কর্মজীবন নিয়ে ‘প্রতিদিন’ কাগজে লিখেছিলেন। বই হয়েছিল কি না জানা যায় না। নির্মল সেনগুপ্ত নামে একজন প্রতি শুক্রবার করে সমীক্ষা পড়তেন। ওই রকম উপস্থাপনা আর দেখিনি। একমুখ দাড়ি নিয়ে তরুণ চক্রবর্তীর কন্ঠস্বরও খুব আকর্ষণীয় ছিল। খুব দ্রুত, স্পষ্ট উচ্চারণে খবর পড়তেন। তরুণবাবু কবিতা আবৃত্তিও করেছেন। একসময় ছবি করারও চেষ্টা করেছিলেন। রেডিওর সঙ্গে টিভিতেও খবর পড়তেন। দেবদুলালবাবুও টিভিতে খবর পড়তেন। কিন্তু  ততদিনে চোখের প্রবলেম শুরু হয়েছে।

যখন ঘরে ঘরে টিভি আসেনি সেসমযে রেডিওই ছিল সম্প্রচারের মাধ্যম। সকাল ৬.২০-এর সংবাদ খুব জনপ্রিয় ছিল। ওইরকম কাভারেজ ভাবা যায় না। ভবেশ দাশের ‘সম্প্রচারের ভাষা ও ভঙ্গী’ নামক বইযে অনেক কিছু জানা যায়। উনি নিজেও খুব ভালো সমীক্ষা পড়তেন। অসাধারণ কন্ঠ। আমরা যারা একসময় অলক চক্রবর্তীর পদার্থবিদ্যা পড়েছি। ওঁর মা ছিলেন ইন্দিরাদেবী। ছোটোদের আসর ‘শিশুমহল’ টানা ৩৭ বছর পরিচালনা করে এসেছেন। ওঁরই সমসাময়িক বেলা দে। ‘মহিলামহল’ পরিচালনা করতেন। খুব জনপ্রিয় হয়েছিল অনুষ্ঠানদুটি।

মিহির বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালনা করতেন ‘সবিনয় নিবেদন’। অত্যন্ত সংযত গাম্ভীর্যে শ্রোতাদের প্রশ্নের উত্তর দিতেন। প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র প্রমুখের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন মিহির বন্দ্যোপাধ্যায়। ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত মিহিরবাৱুকে দেখে বোঝা যেত কেন ওইরকম ব্যারিটোন কন্ঠস্বর।

কবি ও নাট্য প্রযোজক অজিত বসু থাকতেন শ্যামবাজারে। খুব সাধাসিধে চেহারা। ‘স্বরক্ষেপ’ নামক লিটিল ম্যাগাজিন বার করতেন। অনেক নাটক প্রযোজনা করেছেন। মহাশ্বেতা দেবী খুব পছন্দ করতেন তাঁকে। শেষের দিকে ‘বিবিধ ভারতী’তেই বেশি ডিউটি করতেন। পার্থ ঘোষ বিখ্যাত ছিলেন তাঁর ‘গল্পদাদুর আসর’ পরিচালনার সূত্রে। খুব মিষ্টি করে বলতেন ‘চলি ভাই’। একেবারে নিজস্ব স্টাইলে। গৌরী ঘোষের আবৃত্তি যাঁরা শুনেছেন তাঁরা জানেন গৌরীর কন্ঠস্বরের নমনীয়তা। অনেক রেকর্ড। অনেক গীতিনাট্যে তাঁর নেপথ্য কন্ঠস্বর শোনা যায়।

একদা রেডিও স্টাফ কাজী সব্যসাচী আবৃত্তি করে বিশেষ করে বাংলা কবিতা শম্ভু মিত্রের পর ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। বিজ্ঞাপনদাতার অজস্র অনুষ্ঠান কাজী সব্যসাচী ও শ্রাবন্তী মজুমদার করেছেন। গত দশকে রেডিওর বিনোদন অনুষ্ঠানে বিশেষ করে বিজ্ঞাপনদাতাদের শ্রাবন্তী মজুমদার একাই ধরে রেখেছিলেন। তাঁর বোরোলীনের জিংগিল প্রায় আমাদের বাচ্চাদের কাছে প্রায় ‘জাতীয়সংগীত’ হয়ে উঠেছিল। অন্য মিডিয়ার চাপে রেডিও তার কৌলীন্য হারিয়েছে। কিন্তু রয়ে গেছে কিছু স্মৃতি। হারিয়ে যাওয়া কন্ঠস্বর এখনও নাড়িয়ে দেয়। দিলীপ ঘোষের ‘বন্দেমাতরম’ দিয়ে অধিবেশন শুরু হওয়া, মনে হত দিনটা ভালো যাবে। এখন দিনযাপনের গ্লানিতে যখন মন ভারাক্রান্ত তখন মনে পড়ে তাঁদের অশ্রুত কন্ঠস্বর।

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version