Homeপ্রবন্ধচটি, মাকু এবং চাড্ডি: বাংলায় রাজনৈতিক পরিচয়ের তিন প্রতীক

চটি, মাকু এবং চাড্ডি: বাংলায় রাজনৈতিক পরিচয়ের তিন প্রতীক

প্রকাশিত

রাজনৈতিক বিতর্ক ও বিরোধিতা সবসময়ই থাকবে। কিন্তু সেই বিরোধিতার প্রকাশ সময়ের মতো করে বদলায়। কোনটা কখন শালীন আর অশালীন সেটাও আপাত। বিভিন্ন দল ও নেতারা ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য একে অন্যের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্বক ভাষা ব্যবহার করেন। রাজনৈতিক দলের কর্মী-সমর্থকরাও নিজেদের মতো করে গুছিয়ে নেন।

ভারতের রাজনীতিতে দলীয় সমর্থকদের নিয়ে নানা ধরনের পরিচয়, প্রতীক, এবং ব্যাখ্যা তৈরি হয়। যা কখনও কখনও তাদেরকে সরলতর বা মজার মোড়কে উপস্থাপন করে। বর্তমানে তেমনই তিনটি জনপ্রিয় প্রতীক হল “চটি,” “মাকু,” এবং “চাড্ডি”। এই তিনটি শব্দ যথাক্রমে তৃণমূল কংগ্রেস, সিপিএম, এবং বিজেপির সমর্থকদের কটাক্ষ করতে ব্যবহৃত হয়। এই তিনটি শব্দ রাজনীতির ময়দানে দলের অনুগামীদের ভিন্ন এক চেহারা তুলে ধরে। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে এই তিন শব্দের ব্যবহার এখন ব্যাপক।

এটা যে শুধুমাত্র ভারতে সীমাবদ্ধ, সেটাও নয়। মার্কিন মুলুকে তাকান। সেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তাঁর সমর্থকরা বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর নেতাদের “ক্রুকড হিলারি” (হিলারি ক্লিনটন), “স্লিপি জো” (জো বিডেন), এবং “লিটল মার্কো” (মার্কো রুবিও)-র মতো আক্রমনাত্মক এবং কার্যত অপমানজনক ডাকনাম ব্যবহারের জন্য পরিচিত। টুইটারের মতো প্ল্যাটফর্মগুলিতে প্রতিপক্ষকে এমন ভাষায় আক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সেখানেও। তবে এখানকার রাজনৈতিক আবহাওয়ায় চটি, মাকু এবং চাড্ডির ঝাঁঝ অনেকটাই বেশি।

চটি

তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থকদের সাধারণভাবে “চটি” বলে কটাক্ষ করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তৃণমূল প্রায় দেড় দশক ধরে ক্ষমতায় থাকায় তাদের সমর্থকদের অনেকেই সরকারি সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করার অভিযোগের মুখে পড়েছেন। “চটি” শব্দটি তাই এমন সমর্থকদের জন্য প্রযোজ্য হয়ে উঠেছে, যাঁরা সরকার-ভজনা করে সবকিছুতে সুবিধা আদায় করে নিতে চান। যেহেতু তৃণমূলনেত্রী হাওয়াই চটি পরেন। তৃণমূল বিরোধীরা মনে করেন, তৃণমূলের সমর্থকরা সহজে নিজেদের ফয়দা লুঠতে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারে। তবে তৃণমূল সমর্থকেরা এই সমালোচনা উড়িয়ে দিয়ে নিজেদের দলকে জনমুখী এবং গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের প্রতীক হিসেবে দাবি করেন। হাওয়াই চটি পরিহিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অদম্য ক্ষমতার গুণকীর্তন করেন। দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিরবচ্ছিন্ন লড়াইকে সামনে রাখেন তাঁরা।

মাকু

মাকু, অর্থাৎ সিপিএমের সমর্থকদের উদ্দেশে একটি তির্যক প্রতীক। তাঁত শিল্পে ব্যবহৃত মাকুর সঙ্গে তুলনা করে এটি সৃষ্টি হয়েছে। বঙ্গরাজনীতিতে মার্কস থেকে কটাক্ষজনিত কারণে মাকুর উৎপত্তি। মাকু বলতে সিপিএমের সেই সব সমর্থকদের বোঝানো হয়, যারা দীর্ঘদিনের বাম রাজনীতির সমর্থক এবং আদর্শগত ভাবে শ্রমিক ও কৃষকদের পক্ষে। বাংলায় সরকার থেকে চলে যাওয়ার পর বামদলের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে। কিন্তু মাকু হিসেবে দেগে দেওয়া বর্তমান বাম সমর্থকেরা এখনো নিজেদের আদর্শের প্রতি অটল। তাঁদের বিশ্বাস, সমাজের শ্রেণিবিভাগ দূর করতে এবং সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে শুধু সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি। সময়ের সঙ্গে তাঁদের আদর্শের পথ পরিবর্তন হয়েছে ঠিকই, তাঁরা কিন্তু বিশ্বাস করেন যে নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁদের মূল্যবোধ এখনও প্রাসঙ্গিক। উল্লেখযোগ্য ভাবে, বামফ্রন্ট যখন সরকারে ছিল, তখন তাদের একটা অংশকে বিরোধীরা হার্মাদ কটাক্ষে বিঁধত। এখন সে শব্দের ব্যবহার অনেক কম, জায়গা নিয়েছে মাকু।

চাড্ডি

“চাড্ডি” শব্দটি বিজেপি এবং আরএসএসের সমর্থকদের বোঝাতে ব্যবহৃত হয়, যা আরএসএসের ঐতিহ্যবাহী খাকি হাফ প্যান্টের (চাড্ডি) সঙ্গে যুক্ত। সমালোচকেরা বিজেপির সমর্থকদের ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা হিসেবে চিত্রিত করে থাকেন এবং তাদের কঠোর আদর্শগত অবস্থানকে কটাক্ষ করে এই শব্দ ব্যবহার করেন। বিজেপির সমর্থকরা অবশ্য নিজেদেরকে চাড্ডি বলে পরিচয় দিতে আপত্তি করেন না, তাঁরা এটিকে একধরনের গর্ব হিসেবে মনে করেন, কারণ তাঁদের মতে, এটি তাঁদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি অঙ্গীকারের প্রতীক। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। যদিও ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসতে পারেনি। ২০২৪ লোকসভায় ফল আরও হতাশাজনক। ফলে বিজেপির সমর্থকরা রাজ্যের রাজনীতিতে তাঁদের গুরুত্ব টিকিয়ে রাখতে জোর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। চটি, মাকু- দুই শিবিরের সঙ্গেই লড়তে হচ্ছে তাঁদের।

মতাদর্শের সংঘাত

চটি, মাকু, এবং চাড্ডি—এই তিনটি শব্দের ব্যবহার সাধারণত মজার ছলে হলেও, এগুলো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনুগামীদের পরিচয় বহন করে। প্রতিটি দলই তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক মতাদর্শ ও সমর্থনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়। আর তাদের সমর্থকদের এ ধরনের কটাক্ষ মিশ্রিত ডাকনাম তাঁদের রাজনীতির প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। সমালোচনা ও কৌতুকের জন্য এসব প্রতীকী শব্দ ব্যবহৃত হয় ঠিকই, তবে এগুলোর মাধ্যমে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের সংঘর্ষও প্রতিফলিত হয়ে চলেছে।

অন্য একটি মহলের মতে, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের মধ্যে যে তীব্র সংঘাত এবং টানাপোড়েন দেখা যাচ্ছে, তা শুধু রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতাকেই নয়, বরং সামাজিক বিভাজনের এক স্পষ্ট ছবিও তুলে ধরে। এই সংঘাত শুধুমাত্র ভোটের লড়াইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ওপরও প্রভাব ফেলছে। চটি, মাকু, এবং চাড্ডি পর্যায়ের এই লড়াই রাজ্যের সামাজিক ভবিষ্যত নির্ধারণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে!

আপনার প্রশ্ন, আমাদের উত্তর

সাম্প্রতিকতম

আমেরিকার নন-ইমিগ্রান্ট ভিসার নিয়ম বদল, ভারতীয়দের জন্য বাড়ল বি১-বি২ ভিসার অপেক্ষার সময়

আমেরিকার এনআইভি ভিসার নতুন নিয়মে আবেদনকারীদের নিজের দেশেই ইন্টারভিউ দিতে হবে। ফলে ভারতীয়দের বি১-বি২ ভিসা পেতে আরও বেশি অপেক্ষা করতে হবে।

১৫ সেপ্টেম্বর থেকে বর্ষা বিদায় রাজস্থানে, পূর্ব ভারতে বাড়ছে বৃষ্টির দাপট; উত্তরবঙ্গে অতি ভারী বর্ষণের সতর্কতা

১৫ সেপ্টেম্বর থেকে রাজস্থান থেকে বর্ষা বিদায় শুরু হবে। পূর্ব ভারতে বৃষ্টির দাপট বাড়বে। উত্তরবঙ্গে অতি ভারী বর্ষণের সতর্কতা, দক্ষিণে বিক্ষিপ্ত বৃষ্টির সম্ভাবনা।

হীরক জয়ন্তী বর্ষে বেহালা নূতন দল, দর্শনার্থীদের নিয়ে যাবে রাজা বীর সিংহ ও রাই কুমারীর দেশে

বেহালা নূতন দলের এবারের হীরক জয়ন্তী পুজোর থিম ‘শিবাণী ধাম’। রাজা বীর সিংহ ও রাই কুমারীর ঐতিহাসিক কাহিনি মণ্ডপে জীবন্ত হয়ে উঠছে।

দুর্গাপুজোর মুখে কলকাতায় প্রধানমন্ত্রী মোদী, ১৪-১৫ সেপ্টেম্বর একাধিক রাস্তায় ট্রাফিক বিধিনিষেধ

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফর উপলক্ষে ১৪ ও ১৫ সেপ্টেম্বর কলকাতায় একাধিক রাস্তায় ট্রাফিক বিধিনিষেধ জারি করল পুলিশ। জানুন কোন রাস্তায় কবে নিষেধাজ্ঞা থাকবে।

আরও পড়ুন

স্বাধীনতা আন্দোলনের অলিখিত ইতিহাস: ভুলে গিয়েছি অগ্নিস্নাত বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষকে  

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায় মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করেননি। বিধানচন্দ্র রায়কে আশীর্বাদও করেননি। বল্লভভাই পটেলের...

স্বাধীনতা আন্দোলনের অলিখিত ইতিহাস: ‘এবার তবে আসি মা!’

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায় একটা সুবৃহৎ দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস এত পক্ষপাতিত্ব করে লেখা হয়েছে, যার উদাহরণ...

স্বাধীনতা আন্দোলনের অলিখিত ইতিহাস: জালিয়ানওয়ালাবাগ ও উধম সিং

সে দিন ব্রিটিশ শাসক অসংখ্য নিরপরাধ ভারতীয় নরনারীকে বুলেটের বন্যায় ধরাশায়ী করেই ক্ষান্ত হয়নি, শহরের গণ্যমান্য নাগরিকদের ঘর থেকে বাইরে টেনে টেনে এনে রাস্তায় হামাগুড়ি দিতে বাধ্য করেছিল। প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপথে ভারতীয়দের নাকে খত দিতে বাধ্য করেছিল ব্রিটিশ শাসক সে দিন।