শম্ভু সেন
পল্টনে থাকার সময় করাচি সেনানিবাস থেকে কাজী নজরুল ইসলাম কলকাতার ‘সবুজপত্র’-এ প্রকাশের জন্য একটি কবিতা পাঠিয়েছিলেন। সেটি ছিল হাফিজের একটি গজলের অনুবাদ। ‘সবুজপত্র’ সেটি খারিজ করে দেয়। শেষ পর্যন্ত ‘প্রবাসী’ সেই কবিতা ছেপেছিল। ঘটনাটা একটু বিস্তারিত ভাবে বলা যাক।
কিশোর বয়সে রাঢ়বঙ্গের ভ্রাম্যমাণ নাট্যদল ‘লেটো’তে থাকার সময় নজরুল পালাগান বেঁধেছেন, কবিতা রচনা করেছেন। তবু সাহিত্যকেই ধ্যানজ্ঞান ভেবে নজরুল নিয়মিত সাহিত্যচর্চা শুরু করেছিলেন পল্টনে থাকার সময়।
নজরুলের চোখে-মুখে তখন দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করার স্বপ্ন। সেই স্বপ্নকে সার্থক করতে হলে সৈনিক হতে হবে। বিশ্বে তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা। নজরুল ভাবলেন, সৈনিক হওয়ার এই সুযোগ। যেমন ভাবা তেমন কাজ। রানিগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ হাইস্কুলের দশম শ্রেণির বৃত্তি পাওয়া অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র নজরুল স্কুল পালিয়ে যোগ দিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য গঠিত ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে। প্রথমে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে, তার পর সীমান্ত প্রদেশের নওশেরায় এবং শেষে করাচি সেনানিবাসে তাঁর সৈনিক জীবন কাটে। নজরুল সেনাবাহিনীতে ছিলেন ১৯১৭-এর শেষ দিক থেকে ১৯২০-এর মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত। এই আড়াই বছরে সাধারণ সৈনিক কর্পোরাল থেকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন নজরুল।
৪৯ বাঙালি রেজিমেন্টে থাকাকালীন ব্যারাকের সবাইকে প্রাণচাঞ্চল্যে মাতিয়ে রাখতেন নজরুল। প্রায়ই সন্ধ্যায় বসাতেন গানের আসর। সহযোদ্ধাদের দু–একজন তাল মেলাতেন। ফলে গান জমে উঠত। হাসি-গানে–ঠাট্টায় সবাইকে মাতিয়ে দিতে নজরুল ছিলেন একাই একশো। সব সময় এ ভাবে হই হই করে পল্টন মাতিয়ে রাখতেন বলে কবির নামই হয়ে গিয়েছিল ‘হই হই কাজী’।
করাচি সেনানিবাসে একজন আরবি-ফারসি জানা পাঞ্জাবি সেনানীর সঙ্গে নজরুলের ঘনিষ্ঠতা হয়। এঁর সূত্রেই নজরুলের সাহিত্যচর্চার সূত্রপাত বলা যায়। এ প্রসঙ্গে ‘রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ’ গ্রন্থের মুখবন্ধে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন: “…আমি তখন স্কুল পালিয়ে যুদ্ধে গেছি। সে আজ ইংরেজি ১৯১৭ সালের কথা। সেইখানে প্রথম আমার হাফিজের সাথে পরিচয় হয়। আমাদের বাঙালি পল্টনে একজন পাঞ্জাবী মৌলবী সাহেব থাকতেন। একদিন তিনি দীওয়ান-ই-হাফিজ থেকে কতকগুলি কবিতা আবৃত্তি ক’রে শোনান। শুনে আমি এমনই মুগ্ধ হয়ে যাই যে, সেইদিন থেকেই তাঁর কাছে ফার্সি ভাষা শিখতে আরম্ভ করি। তাঁরই কাছে ক্রমে ফার্সি কবিদের প্রায় সমস্ত বিখ্যাত কাব্যই পড়ে ফেলি। তখন থেকেই আমার হাফিজের ‘দীওয়ান’ অনুবাদের ইচ্ছা হয়। কিন্তু তখনো কবিতা লিখবার মত যথেষ্ট সাহস সঞ্চয় ক’রে উঠতে পারিনি। এর বৎসর কয়েক পরে হাফিজের ‘দীওয়ান’ অনুবাদ করতে আরম্ভ করি। অবশ্য তাঁর রুবাইয়াৎ নয় – গজল।”
নজরুলের ঘনিষ্ঠ সুহৃদ মুজফ্ফর আহমদ বলেছেন, “পাঞ্জাবী মৌলবী সাহেবের কাছেই যদি সে প্রথম পারসী (ফারসি) ভাষা শেখা আরম্ভ ক’রে থাকে তবে মেট্রিকুলেশন ক্লাস পর্যন্ত পারসীর (ফারসি) ক্লাসে সে কোন্ ভাষা পড়েছিল? আসলে পাঞ্জাবী মৌলবীর কাছে সে হাফিজের ‘দিওয়ান’ পড়া আরম্ভ করেছিল। তার ভিতর দিয়ে তার পারসী (ফারসি) ভাষার জ্ঞানও বেড়েছিল।” মুজফ্ফর আহমদ মনে করেন আসলে নজরুল ‘রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ’ গ্রন্থের মুখবন্ধ পুত্র বুলবুলের মৃত্যুর পরে পরেই লিখেছিল। তাই তাঁর মন ঠিক ছিল না।
ঘটনা যা-ই হোক, করাচি সেনানিবাসে থাকাকালীন পাঞ্জাবী মৌলবীর কাছে চর্চা করে নজরুল যে ফারসি ভাষায় তাঁর জ্ঞান অনেক বাড়িয়েছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এখানেই তিনি বাংলা সাহিত্যের অনুশীলনের পাশাপাশি শুরু করেন হাফিজের গজলের অনুবাদ। তিনি সেই সব লেখা পাঠিয়ে দিতেন বাংলার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। আর রচনার শেষে লিখতেন – কাজী নজরুল ইস্লাম (হাবিলদার, বঙ্গবাহিনী; করাচি।)।
পল্টনে নজরুল।
১৯১৯-এর শেষ দিকে ‘সবুজপত্র’-এর সহকারী সম্পাদক পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে এসে পৌঁছোল নজরুলের একটি চিঠি এবং তার সঙ্গে পত্রিকায় প্রকাশের জন্য একটি কবিতা। পবিত্রবাবু ওই কবিতা যথারীতি পত্রিকা-সম্পাদক প্রমথ চৌধুরীর কাছে পাঠিয়ে দেন। ক’দিন বাদে প্রমথ চৌধুরী জানান, তিনি ওই কবিতা প্রকাশে ইচ্ছুক নন।
‘সবুজপত্র’ সম্পাদকের সিদ্ধান্তে ব্যথা পেয়েছিলেন সহ-সম্পাদক পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি লিখেছেন, “বহুদূর প্রবাসে এক বাঙালী যুবক আত্মীয় পরিজন-বর্জিত হয়ে জীবন-মরণের খেলা খেলছে, দুটো মনের কথা নিপুণ হাতে ছন্দে গেঁথে সে জানাতে চাইছে তার বাঙালী আপনার জনকে। হয়ত রবীন্দ্রনাথের কবিতার পাশে রেখে তাকে ভাল কবিতাও বলা চলে না। কিন্তু তার মধ্যে যে প্রাণের কথা উৎসারিত, আর যে মিষ্টি বাঁধুনী – তা আমাকে মুগ্ধ করল।”
কবিতাটি কোনো পত্রিকাতেই প্রকাশিত হবে না, এটা ভাবতে পারছিলেন না পবিত্রবাবু। শেষ পর্যন্ত কপাল ঠুকে চলে গেলেন ‘ভারতীয় সাংবাদিকতার পিতামহ’ রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের ‘প্রবাসী’র অফিসে। ‘প্রবাসী’র অফিসটা ছিল সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের পাশের গলিতে। চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তখন ‘প্রবাসী’র সহকারী সম্পাদক। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদক হলেও পত্রিকা সম্পাদনার যাবতীয় কাজ চারুবাবুই করতেন। পবিত্রবাবুর সঙ্গে তাঁর ভালোই আলাপ ছিল। সুদূর করাচি থেকে কাজী নজরুল নামে এক বাঙালি হাবিলদারের কাছ থেকে কবিতা পাওয়া, সেই কবিতা প্রমথ চৌধুরীর সিদ্ধান্তে খারিজ হওয়া – সব কিছু জানিয়ে চারুবাবুর হাতে পারস্যের কবি হাফিজের লেখা গজলের বাংলা অনুবাদটি তুলে দিলেন পবিত্রবাবু।
পবিত্রবাবু লিখছেন, “একবার চোখ বুলিয়েই চারুবাবু বলে উঠলেন, ‘নিশ্চয়ই ছাপব এ কবিতা। পৌষ সংখ্যা বেরুতে আর মাত্র সাত-আট দিন বাকী আছে। তাতে অসুবিধা কিছু হবে। কিন্তু পরবর্তী সংখ্যার জন্য ফেলে রাখা সঙ্গত হবে না’।”
নজরুলের ‘আশায়’ শীর্ষক সেই অনুবাদ-কবিতা ১৩২৬-এর পৌষের ‘প্রবাসী’তে প্রকাশিত হয়েছিল –
“নাই বা পেল নাগাল, শুধু সৌরভেরই আশে
অবুঝ সবুজ দূর্ব্বা যেমন জুঁই কুঁড়িটির পাশে
বসেই আছে, তেম্নি বিভোর থাক রে প্রিয়ার আশায়
তার অলকের একটু সুবাস পশ্বে তোরও নাশায়।
বরষ শেষে একটি বারও প্রিয়ার হিয়ার পরশ
জাগাবেরে তোরও প্রাণে অমনি অবুঝ হরষ!”
নজরুলের কবিতা শেষ পর্যন্ত প্রকাশিত হল প্রবাসী পত্রিকায়।
‘প্রবাসী’তে নজরুলের কবিতা যে দিন বেরুল, পবিত্রবাবুর আনন্দ দেখে কে! যেন ব্যক্তিগত জয়ের গর্বে গর্বিত। নজরুলকে সরাসরি চিঠি লিখে ‘সবুজপত্র’-এর বদলে ‘প্রবাসী’তে কবিতা প্রকাশের খবরটি দিলেন পবিত্রবাবু আর জানিয়ে দিলেন ‘প্রবাসী’র সংখ্যাটি নজরুলকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তার সঙ্গে এ-ও জানাতে ভুললেন না যে, ‘সবুজপত্র’-এ কবিতাটি প্রকাশ করা সম্ভব না হওয়ায় তিনি নিজের দায়িত্বে নজরুলের অনুমতি না নিয়েই ‘প্রবাসী’তে সেটি ছাপিয়েছেন। এর জন্যে যদি নজরুলের কোনো ক্ষোভের কারণ হয়, তা হলে সে দায়িত্ব সম্পূর্ণ পবিত্রবাবুর।
পবিত্রবাবুর চিঠির জবাবে নজরুল লিখেছিলেন, “…‘প্রবাসী’তে বেরিয়েছে ‘সবুজপত্র’-এ পাঠানো কবিতা, এতে কবিতার মর্য্যাদা বেড়েছে কি কমেছে, তা আমি ভাবতে পারছি না। ‘সবুজপত্র’-এর নিজস্ব আভিজাত্য থাকলেও ‘প্রবাসী’র মর্য্যাদা এতটুকুও কম নয়। প্রচার আরও বেশী।… বাঙ্গালীর কাছে পৌঁছে দেবার ও যোগ্য বাহনে পরিবেশন করবার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব আপনার।”
নজরুলের চিঠির জবাবে পবিত্রবাবু আরও একটি চিঠি লেখেন। তার জবাবে নজরুল লিখেছিলেন, “… চুরুলিয়ার লেটুর দলের গান লিখিয়ে ছোকরা নজরুলকে কে-ই বা এক কানাকড়ি দাম দিয়েছে! স্কুল-পালানো, ম্যাট্রিক-পাশ-না-করা পল্টন-ফেরত বাঙ্গালী ছেলে কী নিয়েই-বা সমাজে প্রতিষ্ঠার আশা করবে! আমার একমাত্র ভরসা মানুষের হৃদয়। হয় ত তা আগাছা বা ঘাসের মত অঢেল খুঁজে পাওয়া যায় না, কিন্তু বাঙ্গালা দেশে যে তা দুর্লভ নয়, তার প্রমাণ আমি এই সুদূরে থেকেও পাচ্ছি। নিঃসঙ্কোচে ও নির্ব্বিকারে প্রাণ-দেওয়া-নেওয়া প্রত্যক্ষ করেছি। কিন্তু মন-দেওয়া-নেওয়া যে স্থান-কাল-দূরত্বের ব্যবধান মানে না, তাও উপলব্ধি করছি।”
পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে নজরুলের চাক্ষুষ আলাপ এই ঘটনার প্রায় আট মাস পরে। এই সময়ে দু’ জনের মধ্যে চিঠি চালাচালি হয়েছে। ১৯২০-এর মার্চ নাগাদ ব্রিটিশ সরকার বাঙালি রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়ায় নজরুল কলকাতায় চলে আসেন। নজরুলকে চাক্ষুষ দেখতে পবিত্রবাবু চলে এলেন ৩২ কলেজ স্ট্রিটে তাঁর ডেরায়। আলাপ হল। পবিত্রবাবু গোড়া থেকেই ‘তুমি’ করে সম্বোধন করলেন নজরুলকে। আর নজরুল সামান্য সময় নিলেন ‘তুমি’তে আসতে। একটু পরেই চলে এলেন শৈলজা – নজরুলের বাল্যবন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। শৈলজা আর পবিত্রর মধ্যে আলাপ করিয়ে দিলেন নজরুল – ‘এই হল শৈলজা’ আর ‘এই হল পবিত্র’। “পবিত্র, মানে যিনি ‘প্রবাসী’তে তোর কবিতা ছাপিয়ে দিয়েছিলেন?” – বলে উঠলেন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। এ কথা শুনে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় বলে উঠলেন – “মানে তিনি, যিনি ‘সবুজপত্র’-এর সহকারী হয়েও একটা ভাল কবিতা সেখানে ছাপাতে পারেন না।”
“সাহিত্যের একটা আভিজাত্য আছে দাদা। সেটাকে চ্যাংড়াদের হাতে নষ্ট করতে দেওয়া যেতে পারে না” – এ কথা বলে পবিত্রবাবুর আক্ষেপ হেসে উড়িয়ে দিলেন শৈলজানন্দ। রঙ্গ-রসিকতায় তিন জনের আড্ডা জমে উঠল।
তথ্যসূত্র:
চলমান জীবন (দ্বিতীয় পর্ব) – পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়
নজরুল রচনাবলী, ৪র্থ খণ্ড, বাংলা একাডেমী, ঢাকা
কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা — মুজফ্ফর আহমদ