শম্ভু সেন
রাত পোহাতেই এল শিউলি-ফোটা শরতের সেই ভোর। বেজে উঠল সেই সুর, যে সুরের মায়াজালে বাঙালি বন্দি দীর্ঘ বিরানব্বইটা বছর। পুজোর ঢাকে কাঠি পড়ে গেল। গাওয়া হল সেরা আগমনী – বাঙালি সংস্কৃতিজীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ‘মহিষাসুরমর্দিনী’।
জন্মকাহিনি
কী ভাবে জন্ম হল আকাশবাণী কলকাতার সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র? সে কাহিনি শুনিয়েছেন পঙ্কজকুমার মল্লিক তাঁর স্মৃতিকথা ‘আমার যুগ আমার গান’ গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন, “…ধর্মপ্রাণ বাঙালী হিন্দুর ঘরে বার মাসে তের পার্বণ। আর, সব পার্বণের বড় পার্বণ দুর্গাপূজা – মহাদেবীর আবাহন। আমরা ভাবলাম, দশভুজা দুর্গতিনাশিনীর বার্ষিক আরাধনার শুভ উদ্বোধন যদি একটা সাড়ম্বর বেতার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে করা যায় তো কেমন হয়। বন্ধুবর বাণীকুমারই প্রথম পরিকল্পুনাটি আমাদের সামনে রেখেছিল। আমরা তখন সকলে মিলে আলোচনা করে অনুষ্ঠানের সামগ্রিক পরিকল্পনাটি দাঁড় করিয়েছিলাম। ভাষ্য, স্ক্রিপ্ট ও গীত-রচনার দায়িত্ব নিল বাণীকুমার, সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব আমার এবং ভাষ্যপাঠ ও চণ্ডীপাঠের দায়িত্ব নিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। স্ক্রিপ্টরচনায় বাণীকুমারকে সাহায্য করেছিলেন আমাদের অন্তরঙ্গ বন্ধু বিশিষ্ট পণ্ডিত অশোকনাথ শাস্ত্রী মহাশয়।…
“এই অনুষ্ঠান সর্বপ্রথম আরম্ভ হল ১৯৩২ সালে। প্রথম বছরে অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়েছিল মহাষষ্ঠীর দিন প্রভাতে। কিন্তু তার পরের বছর (নাকি, তারও পরের বছর থেকে?) অনুষ্ঠানের সময়সূচি পরিবর্তন করা হলো। পিতৃপক্ষের সমাপ্তি দিবসে পবিত্র মহালয়া উপলক্ষে ছুটি থাকায় ঐ দিনটিকে উপযুক্ত মনে করা হলো। তা ছাড়া, দেবীপক্ষ আরম্ভের প্রাক্কালে পবিত্র মহালয়া তিথির সেই ব্রাহ্মমুহূর্তে ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা যখন যাবেন পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গায় পিতৃপুরুষের তর্পণ করতে, তখন সেই মাহেন্দ্রক্ষণে আমরা দেবী মহিষাসুর-মর্দিনীর বন্দনা করে দেবীপক্ষকে আবাহন করলে তা অনেক বেশি মনোজ্ঞ হবে।”
পঙ্কজকুমার মল্লিক লিখেছেন, “আমার পিতৃদেবের ধর্মপ্রাণতা ধারাবাহিক ভাবে আমার মধ্যে কিছুটা সঞ্চারিত হয়েছিল। তাই এই অনুষ্ঠানের সুর রচনায় আমার প্রাণের সমস্ত ভক্তি ও নিষ্ঠা আমি উজাড় করে ঢেলে দিয়েছিলাম। তার পুরস্কারও পেয়েছিলাম অগণিত প্রশংসাসূচক চিঠি ও সমালোচনায়। বাণীকুমারের সুনির্মল ভাষা ও সুললিত গীতরচনা এবং বীরেন্দ্রকৃষ্ণের রসমধুর আবৃত্তি, ভাষ্যপাঠ ও মহিমান্বিত চণ্ডীপাঠের গুণে এই অনুষ্ঠান যেন ষড়ৈশ্বর্যে বিভূষিত হয়ে উঠেছিল।”
‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র প্রাণপুরুষ তিন জন – বাণীকুমার, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ও পঙ্কজকুমার মল্লিক।
বাণীকুমার
আসল নাম বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য। ১৯০৭ সালের ২৩ নভেম্বর হাওড়া জেলার আমতা অঞ্চলের কানপুর গ্রামে জন্ম। আদি বাড়ি ছিল হুগলি জেলার আঁটপুরে। বাবা বিধুভূষণ ভট্টাচার্য আর মা অপর্ণা ভট্টাচার্য। বাবা ছিলেন পণ্ডিত মানুষ এবং সে যুগের একজন ঐতিহাসিক।
বাণীকুমারের পড়াশোনা প্রথমে কানপুরে, পরে কলকাতায়। তিনি মনেপ্রাণে রবীন্দ্রনাথের একান্ত অনুরাগী ছিলেন। আর কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠ হৃদ্যতা। বাণীকুমার ছিলেন অত্যন্ত স্বল্পবাক চরিত্রের মানুষ। কিন্তু অন্তরে ছিল শিশুর মতো সরলতা।
তিনি আকাশবাণীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রোগ্রাম ডাইরেক্টর। ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’ এবং ‘মার্কণ্ডেয় পুরাণ’ অবলম্বনে তিনি রচনা করেছিলেন ‘বসন্তেশ্বরী’ গীতিআলেখ্য। পরে রচনা করেন ‘শারদ বন্দনা’, যা ১৯৩২ সালে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ নাম নিয়ে মহালয়ার ভোরে আকাশবাণী থেকে আজও প্রায় ৯২ বছর ধরে সম্প্রচারিত হয়ে আসছে। তিনি ছিলেন সুলেখক। তাঁর অনেক লেখাই বহু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৭৪ সালের ১৫ আগস্ট তাঁর প্রয়াণ ঘটে।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র
১৯০৫ সালের ৪ আগস্ট বীরেন্দ্রকৃষ্ণ কলকাতার আহিরীটোলায় মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তখন সারা বাংলায় বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন চলছে। পথে নেমেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ-সহ আপামর বাঙালি। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের বাবা রায়বাহাদুর কালীকৃষ্ণ ভদ্রও রবীন্দ্রনাথের অনুগামী, অনুরক্ত ছিলেন। তিনি কবিগুরুর কাছে পুত্রের নামকরণের অনুরোধ জানালে কবিগুরু নাম দিয়েছিলেন ‘বীরেন্দ্র’। মা সরলা দেবী।
পড়াশোনা এই কলকাতাতেই। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ অত্যন্ত রবীন্দ্র-অনুরাগী ছিলেন। ১৯৪১ সালে ২২ শ্রাবণ কবিগুরুর মহাপ্রয়াণের দিন তাঁর অন্তিমযাত্রার বিবরণী আকাশবাণী থেকে প্রচারিত হয়েছিল। সেই মহাপ্রস্থানের ধারাবিবরণী করেছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এবং কবিতাপাঠে ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। সে দিন সারা বাংলা, সারা বিশ্ব কেঁদেছিল সেই প্রাণবন্ত, অশ্রুসিক্ত ধারাভাষ্য শুনে। একই ভাবে ১৯৬১ সালের ১ জুলাই ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের শেষ যাত্রার ধারাবিবরণীও আকাশবাণী থেকে প্রচারিত হয়েছিল। সেই ধারাবিবরণীও করেছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। সে দিনও বাঙালি চোখের জলে ভেসেছিল সেই ধারাভাষ্য শুনে। তাঁর উপস্থাপনার এমনই বিশেষত্ব ছিল।
বীরেনবাবু ১৪টি ভাষায় কথা বলতে পারতেন। আকাশবাণীর সঙ্গে আজীবন যুক্ত ছিলেন। তিনি একাধারে সাংবাদিক, লেখক ও নাট্যকার। অনেক পত্রিকাতেই তিনি লিখতেন। লিখতেন ‘শ্রীবিরুপাক্ষ’ ছদ্মনামে। তাঁর রম্যরচনাগুলি রেডিওয় প্রচারিত হত। তাঁর লেখা নাটক আকাশবাণীতে প্রচারিত হয়েছে। আর মহালয়ার ভোরে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র সংস্কৃত স্তোত্রপাঠ এবং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র আজ বাঙালির কাছে সমার্থক। তাঁর মহাপ্রয়াণ ঘটে ১৯৯১ সালের ৩ নভেম্বর।
পঙ্কজকুমার মল্লিক
১৯০৫ সালের ১০ মে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মনমোহন মল্লিক এবং মা মনমোহিনী দেবী। পড়াশোনা কলকাতাতেই। পাশাপাশি তিনি খুব ভালো গান করতেন। গানের প্রতি টান ছিল আশৈশব। তিনি গানে সুর সংযোজনও করতেন। সেই সব গান শুনে শ্রোতারা মোহিত হয়ে যেতেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন দিনেন্দ্রনাথ।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের (দিনু ঠাকুর নামে যিনি বিখ্যাত) সঙ্গে পঙ্কজকুমারের ঘনিষ্ঠতা ছিল। সেই সুত্রে তিনি রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শে আসেন। পরবর্তী কালে রবীন্দ্রনাথের ‘খেয়া’ কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতা (দিনের শেষে ঘুমের দেশে) তিনি রাবীন্দ্রিক সুরের অনুসরণে সুর দিয়ে কবিগুরুকে অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে শুনিয়েছিলেন দিনু ঠাকুরের জোরজবরদস্তিতে। কবিগুরু খুব প্রশংসা করেছিলেন সেই গান শুনে। তার পর রবীন্দ্রনাথের কাছে অতি স্নেহের পাত্র হয়ে ওঠেন পঙ্কজ কুমার।
পঙ্কজকুমার পরে চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেন। অনেক চলচ্চিত্রে সুরকারও ছিলেন। আকাশবাণীর সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র সংগীত পরিচালক হিসাবে তিনি বাঙলা সংগীতজগতে অমর হয়ে আছেন। তৎকালীন সর্বভারতীয় সংগীত এবং চলচ্চিত্রজগতের সকল ব্যক্তিত্বের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন পঙ্কজকুমার। ১৯৭৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তাঁর প্রয়াণ ঘটে। মহালয়ার ভোরে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ আলেখ্যর গানগুলির মাধ্যমে তিনি চিরঅমর হয়ে রয়েছেন বাঙালির সংস্কৃতিতে।
‘মহিষাসুরমর্দিনী’র জনপ্রিয়তা
ইন্ডিয়ান অডিয়েন্স রিসার্চ ব্যুরোর ২০১৮ সালের একটি সমীক্ষার তথ্য বলছে, মহালয়ার ভোরে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ প্রভাতী অনুষ্টানের শ্রোতা বাংলায় ৯৭ শতাংশ এবং সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভাষায় প্রচারিত হওয়া এই অনুষ্ঠানটির শ্রোতা ৯৮.৪ শতাংশ। এই অনুষ্টানের আর একটি বিশেষত্ব হল, একটানা নয় দশকেরও বেশি সময় ধরে একই ভাবে প্রচারিত হয়ে আসছে, যার কদর এতটুকুও কমেনি। সেই অনুষ্ঠান আজ শতবর্ষ পূর্ণ করার দুয়ারপ্রান্তে।
বাঙালি যত দিন থাকবে, মহালয়ার ভোরে থাকবে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। অনুষ্ঠান শুরু হবে মহিষাসুরমর্দিনীর স্তোত্র ‘সিংহস্থা শশিশেখরা মরকতপ্রেক্ষা’ দিয়ে। তার পর সেই বহুকাঙ্ক্ষিত কণ্ঠে ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর’। তার পর সেই সব গান – ‘বাজল তোমার আলোর বেণু’, ‘জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণধারিণী’ ইত্যাদি। এবং সেই চণ্ডীপাঠ যা চোখে জল এনে দেয় পাঠকের এবং শ্রোতাদেরও – ‘যা দেবী সর্বভুতেষু মাতৃরূপেন সংস্থিতা/নমোস্তস্যই নমোস্তস্যই নমোস্তস্যই নমো নমোহঃ’। সেই সব গান, স্তোত্রপাঠ আর চণ্ডীপাঠে অমর হয়ে থাকুক মা দুর্গার আবাহনী অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দিনী’।