Homeপ্রবন্ধশ্বাসেপ্রশ্বাসে এবং বিশ্বাসে বিদ্যাসাগর, জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

শ্বাসেপ্রশ্বাসে এবং বিশ্বাসে বিদ্যাসাগর, জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

প্রকাশিত

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “আমাদের এই অবমানিত দেশে ঈশ্বরচন্দ্রের মতো এমন অখণ্ড পৌরুষের আদর্শ কেমন করিয়া জন্মগ্রহণ করিল, আমরা বলিতে পারি না। কাকের বাসায় কোকিল ডিম পাড়িয়া যায় – মানব-ইতিহাসের বিধাতা সেইরূপ গোপনে কৌশলে বঙ্গভূমির প্রতি বিদ্যাসাগরকে মানুষ করিবার ভার দিয়াছিলেন।”

রবীন্দ্রনাথের এই মন্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে তাঁর লেখা ‘বিদ্যাসাগরচরিত’ থেকে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রয়াণের অনেক পরে ১৩০২ বঙ্গাব্দের ১৩ শ্রাবণ কলকাতার এমারল্ড থিয়েটার রঙ্গমঞ্চে (পরবর্তীকালের মিনার্ভা থিয়েটার) আয়োজিত বিদ্যাসাগর স্মরণার্থসভার সাংবৎসরিক অধিবেশনে ‘বিদ্যাসাগরচরিত’ শিরোনামে রবীন্দ্রনাথের এই লেখা পাঠ করা হয়। পরে তা তাঁর গ্রন্থ ‘চারিত্রপূজা’য় অন্তর্ভুক্ত হয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠিকই বলেছিলেন। বিদ্যাসাগর ছিলেন এক বিরল ব্যক্তিত্ব। আধুনিক বাংলাভাষার সৃষ্টির কাজে, বাংলা তথা সারা দেশে সকলের জন্য শিক্ষাকে সবার ঘরে নিয়ে যাওয়ার কাজে, বাল্যবিবাহ, পুরুষের বহুবিবাহ ইত্যাদির মতো নানা সামাজিক অন্যায্য প্রথা রদের কাজে, বাল্যবিধবাদের আবার বিয়ে দিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার কাজে, জাত-ধর্ম নির্বিশেষে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের যথাসাধ্য সহযোগিতা করার কাজে বিদ্যাসাগর আমাদের দেশে এক ঐতিহাসিক ব্যতিক্রমী মানুষ।

রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়নে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অন্যতম কীর্তি বাংলাভাষার আধুনিকতা। আধুনিক বাংলাভাষার কাঠামো, বাক্যগঠন, যতি চিহ্নের প্রচলন ও ব্যবহার, যুক্তাক্ষরের রূপ, বাংলাভাষার  মুদ্রণবিধি, গদ্যের বিন্যাস ইত্যাদিতে রয়েছে বিদ্যাসাগরের কালজয়ী যুগান্তকারী অবদান। এই ক্ষেত্রে তিনি পথিকৃৎ।

বিদ্যাসাগরের জন্মদিনে আমরা বলতেই পারি, বিদ্যাসাগরের স্বপ্ন ছিল শিক্ষার সর্বজনীনতা। তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠানবিরোধী, আপসহীন এবং সকলের মঙ্গলার্থতায় একজন উদ্ভাবক-উদ্যোক্তা। বিদ্যাসাগরের জীবনের যাবতীয় কাজের আর একটি দিক হল, ধর্ম-ঔদাসিন্যতা বা ধর্ম-নির্লিপ্ততা, তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতা নয়। বিদ্যাসাগরের শিক্ষাপাঠক্রমে নীতিবোধ শিক্ষা আছে, কোনো ধর্মশিক্ষার জায়গা নেই।

বিদ্যাসাগর সেই যুগে তথাকথিত সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষদের এবং প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন। দেড়শো-দুশো বছর পরে আজকের এই সমাজে যতটুকু ইতিবাচক দিক আমরা দেখতে পাচ্ছি, তার সবই হল বিদ্যাসাগরের সেই বিরুদ্ধতারই সুফল।

এই কাজ একা করতে গিয়ে বিদ্যাসাগর তৎকালীন সমাজের কাছ থেকে, আত্মীয়পরিজনদের কাছ থেকে, সমাজের অধিকাংশ মাতব্বরদের কাছ থেকে, এমনকি কিছু অবোধ সাধারণ মানুষের কাছ থেকেও চরম অপমান সহ্য করেছিলেন। এমনকি তাঁর গায়ে হাত তোলার মতো ব্যাপারও ঘটেছিল, তাঁকে প্রাণে মেরে ফেলার চক্রান্তও হয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথের কথায়, বিদ্যাসাগরের এই অদম্য মনোবলের চালিকাশক্তি ছিল ‘দয়া’। সেই দয়া কোনো আবেগতাড়িত চোখের জলে ভেজা মানসিকতা নয়। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, “তাঁহার দয়ার মধ্য হইতে… নিঃসংকোচ বলিষ্ঠ মনুষ্যত্ব পরিস্ফুট হইয়া ওঠে।” বাইরে কঠিন কঠোর, কিন্তু অন্তরে যেন মাতৃস্নেহের ফল্গুধারার বহমানতা অবিরাম গতিতে। এই ছিল বিদ্যাসাগরের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

তিনি মুসলমান সম্প্রদায়ের কাছে ছিলেন আদরের, সাহায্য সহায়তার স্থান। আবার সেই যুগের হিন্দু নিম্নবর্গের মানুষের কাছেও তিনি ছিলেন এক মনের মানুষ, প্রাণের আশ্রয়। তাই তো, সে দিন বাংলার তাঁতিরা তাঁদের বোনা কাপড়ের উপরে লিখতেন, “বেঁচে থাক বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে/ সদরে করেছ রিপোর্ট, বিধবার হবে বিয়ে।”

বিদ্যাসাগর তাঁর জীবনের শেষ ১৪/১৫ বছর কাটিয়েছিলেন তৎকালীন বিহার অধুনা ঝাড়খণ্ডের কার্মাটারে। সেই এলাকায় জনজাতি, দলিত শ্রেণির বসবাস। তাদের মধ্যে তাদেরই একজন অভিভাবক হয়ে গিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। তিনি নিজের হাতে কলেরা-আক্রান্ত দলিত মহিলা, শিশুদের সেবা করেছেন, তাদের কাছে টেনে নিয়েছিলেন। এর আগেও একবার বর্ধমানের এক বিরাট অঞ্চলে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল। বিদ্যাসাগর তখন বাংলায়। কলকাতা থেকে ডাক্তার সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন সেখানে, গ্রামের দরিদ্র অবহেলিত মানুষের কাছে। সেবা করেছিলেন নিজের হাতে। সে এক বিরলতম ঘটনা।

রবীন্দ্রনাথের কথায়, “এই… প্রতিভা কোনো সাম্প্রদায়িক শাস্ত্র মানিয়া চলে না।…যাঁহারা যথার্থ মনুষ্য, তাঁহাদের শাস্ত্র তাঁহাদের অন্তরের মধ্যে, অথচ বিশ্বব্যাপী মনুষ্যত্বের সমস্ত নিত্যবিধানগুলির সঙ্গে সে শাস্ত্র আপনি মিলিয়া যায়।”

আজ এই সময়ে, যখন অসহিষ্ণুতা, নীচতা, চৌর্যবৃত্তির পরিবেশে আমরা হাতড়িয়ে বেড়াচ্ছি কিন্তু আস্থাকে, বিশ্বাসকে খুঁজে পাচ্ছি না, তখন কঠিন কঠোর ব্রতে একনিষ্ঠ বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব বিদ্যাসাগরকেই আমাদের পাথেয় করা উচিত। তবেই আমাদের মঙ্গল।

আজ বিদ্যাসাগরের পূণ্য পবিত্র জন্মদিনে ‘মানুষ’ হওয়ার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হই।

আরও পড়ুন

‘সার্থক জনম আমার, জন্মেছি এই দেশে’, রবীন্দ্রগানে নিবেদিতা সুচিত্রা মিত্রকে শতবর্ষে শ্রদ্ধার্ঘ্য  

সাম্প্রতিকতম

ডোমজুড়ে রাসায়নিক কারখানায় ভয়াবহ আগুন, বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল এলাকা, আতঙ্কে স্থানীয়রা

হাওড়ার ডোমজুড়ে রাসায়নিক কারখানায় বিধ্বংসী আগুন, একের পর এক বিস্ফোরণে আতঙ্ক ছড়াল। দমকলের ১৫টি ইঞ্জিন আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে।

বিশ্ব রাজনীতির অস্থিরতার মাঝে করুণার কণ্ঠস্বর: এক দশক ধরে পোপ ফ্রান্সিসের প্রগতিশীল পদচারণা

পোপ ফ্রান্সিসের এক দশকের পথচলায় উঠে এসেছে করুণা, জলবায়ু ন্যায়, শরণার্থী অধিকার ও গির্জার সংস্কারের বার্তা। রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন সময়ের গুরুত্বপূর্ণ মানবিক কণ্ঠস্বর।

হিন্দু সমাজে জাতিভেদের অবসান চাই! ‘এক মন্দির, এক কুয়ো, এক শ্মশান’-এর ডাক মোহন ভাগবতের

জাতিভেদের বিভেদ ভুলে হিন্দু সমাজে ঐক্যের বার্তা দিলেন আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত। অলিগড় সফরে দিলেন সামাজিক সম্প্রীতির বার্তা।

কলকাতা বিমানবন্দরে যাত্রা হবে আরও দ্রুত! ডমেস্টিক ট্রান্সফারে চালু হচ্ছে ‘ডিজিযাত্রা’

কলকাতা বিমানবন্দরে এবার আরও দ্রুত ডমেস্টিক কানেক্টিং ফ্লাইটে যাত্রা সম্ভব। ডিজিযাত্রা চালু হচ্ছে ডমেস্টিক-টু-ডমেস্টিক ট্রান্সফার জোনে, উপকৃত হবেন হাজার হাজার যাত্রী।

আরও পড়ুন

মহাকুম্ভে মনালিসার সৌন্দর্যে মুগ্ধ নেটদুনিয়া, অন্ধকারে পারধি সম্প্রদায়ের ইতিহাস ও সংগ্রাম

পারধি শব্দটি এসেছে মারাঠি শব্দ 'পারধ' থেকে, যার অর্থ 'শিকার'। প্রাচীনকালে পারধিরা শিকারি ও বনবাসী হিসেবে পরিচিত ছিল।

বাঘিনি জিনতকে বাগে আনতে হিমসিম বন দফতর, সম্ভাব্য যে কারণে স্থানান্তর করে বাঘেরা

বাঘেদের চলাফেরা এবং আচরণ শুধু তাদের জীবনধারণের অংশ নয়, বরং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ...

পরমাণু অস্ত্রবিরোধী সংগঠন নিহন হিদানক্যো কে শান্তির জন্য নোবেল, এতদিন বাদে কেন?

জাপানের পরমাণু অস্ত্রবিরোধী সংগঠন নিহন হিদানক্যো ২০২৪ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছে, ইরানের সাম্প্রতিক পারমাণবিক অবস্থানের প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাপী নিরস্ত্রীকরণের জরুরি প্রয়োজনকে সামনে আনছে।
কেন লক্ষ্মীর পাঁচালি পাঠ করা হয় রতন টাটার সেরা উক্তি যা আপনাকে অনুপ্রাণিত করবে