পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
‘মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না, ও বন্ধু’ – এই জিজ্ঞাসা অনন্তকাল ধরে মানবসভ্যতায় প্রবহমান। আমাদের ভারতবর্ষের এক অন্যতম রাজ্য উত্তরাখণ্ডের দুর্গম রুদ্ধ টানেলে প্রায় ৪০০ ঘণ্টা ধরে (সেই দেওয়ালির দিন থেকে শুরু হয়ে মঙ্গলবার ২৮ নভেম্বর সন্ধ্যা অবধি) ৪১ জন খননশ্রমিক অবরুদ্ধ ছিলেন। নানা ভাবে চেষ্টা হয়েছে তাদের নিরাপদে উদ্ধার করে আনার। কিন্তু একে একে সব চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছিল। আধুনিক যন্ত্র ‘অগার মেশিন’ মুখ থুবড়ে পড়ার পর, অবশেষে সেই সমস্ত বন্দিপ্রাণকে উদ্ধারের জন্য ডাক পড়েছিল ১২ জন শ্রমিকের। যন্ত্র যখন সম্পূর্ণ হার মানল, তখন ঘামঝরানো শ্রমিকদের কায়িক পরিশ্রমের জয় হল। রক্ষা পেল সেই ৪১ জন অবরুদ্ধ শ্রমিকের জীবন। আবার প্রমাণ হল, যন্ত্র নয়, মানুষই শ্রেষ্ঠ।
আমরা জানি, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়। তাই মনে পড়ে যায় সেই বিশ্ববিখ্যাত জন হেনরির কথা। সেই আফ্রিকান-আমেরিকান মানুষটি, যাঁর কাহিনি বলা হয়েছে ‘ব্লুজ ফোক সং’-এ, ‘দ্য ব্যাল্যাড অফ জন হেনরি’তে। জন্মেছিলেন ১৮৪৮ সালে নিউজার্সিতে। পাহাড়ের বুকে ‘চেজাপিক অ্যান্ড ওহাইও রেল’-এর (সিঅ্যান্ডও রেল) টানেল খনন করতে করতে মেশিনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নিজের জীবন দিয়েছিলেন। এই লোককথা এবং গান প্রথম গেয়েছিলেন হ্যারি বেলাফন্টে, পিট সিগার প্রমুখ। পরে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস – ‘আমি মেশিনের হব প্রতিদ্বন্দ্বী,/ জন হেনরি বলে বুক ঠুকে,/ স্টিম-ড্রিলের সাথে চলে হাতুড়ির পাল্লা/ কে আর বলো তারে রোখে?’
এই ঘটনার ইতিহাস হল, শিল্পবিপ্লবের লাভের ফায়দা তোলার জন্য বিগত উনিশ শতকের মাঝামাঝি আমেরিকায় যেন তেন প্রকারেন খুব দ্রুত রেললাইন বসানোর কাজ হচ্ছিল। সেই সময়ে শ্রমিকদের কাজের কোনো সময়সীমা ছিল না। মজুরিরও কোনো নিশ্চয়তা ছিল না, আর তাদের জীবনের কোনো সুরক্ষাও ছিল না। এমতাবস্থায় আমেরিকার পশ্চিম ভার্জিনিয়ার কাছে ওহাইও-তে পাহাড় কেটে বিগ বেন্ড লুইস টানেলে খননের কাজ করতে এই হেনরি আরও হাজার হাজার শ্রমিকের সঙ্গে যোগ দেন। সেই কাজ আরও কম খরচে করার জন্য স্টিম ড্রিল মেশিন নিয়ে আসে শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মালিকরা। হেনরি সেই স্টিম ড্রিল মেশিনকে চ্যালেঞ্জ করে আরও দ্রুত কাজ করার প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন। মেশিন আর মানুষের লড়াই হয়েছিল শুরু। অবশেষে জয় হয়েছিল হেনরির, জয় হয়েছিল মানুষের। কিন্তু হেনরির ফুসফুস ফেটে যায়, হেনরি মারা যান। সেই সময়ে ‘নাইট্স অফ লেবার’-এর নেতৃত্বে আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলন জন্ম নিয়েছিল, যা সারা পৃথিবীতে পরে ছড়িয়ে পড়ে। জন হেনরির সেই জয়গাথা লোকের মুখে মুখে লোককথা হিসাবে, গান হিসাবে ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দুনিয়ায়।
আজ এই ৪১ জন শ্রমিকভাইকে উদ্ধার করতে জেনেশুনে নিজেদের জীবন বাজি রেখে যে বারো জন শ্রমিক দ্রুত গর্ত খুঁড়ে ফেললেন, তাঁদের নিয়ে আগামীতে কোনো বীরগাথা রচিত হবে কি না জানি না, কিন্তু শাসক নেতানেত্রীরা মনে রাখুন বা না-রাখুন, দেশের এবং দেশের বাইরের শ্রমজীবী খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ তাঁদের মনে রাখবে চিরকাল। ‘চারধামে’ যাতায়াত সহজ করতে সরকারি প্রশাসন এক দুর্বল পাহাড়ি ভূস্তরে চার লেনের সড়ক প্রকল্প রূপায়িত করছে। প্রশাসনের এই অপরিণামদর্শিতার মাশুল দিতে চলেছিলেন ৪১ জন শ্রমিক। তাঁদের উদ্ধার করে নিয়ে এলেন র্যাট-হোল মাইনারদের দল – মুন্না কুরেশি, ফিরোজ, মনু, নাসিম, এরশাদ, অঙ্কুর, রশিদ, যতিন, নাসির, সৌরভ, দেবেন্দর, ওয়াকিক। উদ্ধারকারী সেই দলটিকে (যাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন মুন্না কুরেশি) দেশবাসী জানাবে লাখো লাখো সেলাম। প্রার্থনা করবে ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন বেঁচে-ফিরে-আসা সেই ৪১ জন অবরুদ্ধ শ্রমিকভাই এবং তাঁদের পরিবারপরিজন।
অবশেষে শ্রমজীবী মানুষের জয় হল।
‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ হেনরির হাতুড়ির সুর’।
এই সমাজব্যবস্থায় আমরা জানি, শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের জীবনের কোনো দাম নেই। শেরশাহ, শাজাহানের সময়েও ছিল না। তাই ইতিহাসে আমাদের পড়ানো হয় জিটি রোড তৈরি করেন শেরশাহ। সেখানে সাধারণ শ্রমিকদের কথা লেখা থাকে না। তাজমহল তৈরি করেন শাহজাহান। সেখানে লেখা নেই সাধারণ শ্রমিকদের কথা। ঈশা খাঁয়ের কথা, যাঁর বুড়ো আঙুল কেটে নিয়েছিলেন শাহজাহান।
আসলে এই সব কাজ করতে জীবনের যাবতীয় ঝুঁকি সেই শ্রমিকদেরই বইতে হয়। যেমন আটকে পড়া সাধারণ শ্রমিকদের উদ্ধারের ঝুঁকিও বইতে হল তাদেরই ভাই-বেরাদর সাধারণ শ্রমিকদের। শুধু নানা রকম পরিকল্পনা তৈরি হয় প্রাসাদে বসে, গদিতে বসে। তার পর বিপদে পড়লে তারা একে অপরের ওপর দোষ চাপায়, কিংবা বলে নিয়তির লিখন, সামান্য একটু শোকজ্ঞাপন, কিংবা কিছু টাকার নজরানা। ব্যস, সব মিটে গেল। যার গেল তার গেল।
পরিবেশ, প্রকৃতি, নদী, পাহাড় ধ্বংস হয়, ক্ষতি হয় সাধারণ মানুষের বসতির, প্রকৃতির। যাদের ঘামঝরানো শ্রমের বিনিময়ে এই সব ভয়ংকর ভয়াবহ হঠকারী কাজ হয়, সেই শ্রমিকদের পরে কেউ আর মনেই রাখে না। পাহাড়ের খাদে, বদ্ধ সুড়ঙ্গপথে, চাসনালার খনিতে, কিংবা কোনো জলপ্রপাতের ঢেউয়ে শ্রমিকরা হারিয়ে গেলেও কারও কিছু যেন যায় আসে না। বিস্মৃতির অতলে ওরা হারিয়ে যায়। তার পর একদিন প্রকল্পের উদ্বোধন হয়, মালা পরে ভাষণ দেন নেতানেত্রী, মন্ত্রীরা। আর সাধারণ শ্রমিকদের জন্য? পড়ে থাকে এক হতদরিদ্র, হতচ্ছাড়া মার্কা গড্ডালিকার জীবন। শুধু বোধহয় ইতিহাসে অদৃশ্য নীরব অক্ষরে লেখা থাকে ওদের জন্য – ‘কেউ দেয়নিকো উলু/ কেউ বাজায়নি তো শাঁখ’।
আরও পড়ুন
‘ইঁদুর-গর্ত’ প্রক্রিয়ায় উদ্ধার করা হল আটকে থাকা শ্রমিকদের, জেনে নিন কী সেই প্রক্রিয়া