Home প্রবন্ধ আরজি কর আন্দোলন: রাজ্য-রাজনীতিতে সিপিএমের ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জ

আরজি কর আন্দোলন: রাজ্য-রাজনীতিতে সিপিএমের ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জ

0

গত এক দশকে বাংলার রাজনীতিতে সিপিএমের অবস্থান অনেকটাই কোণঠাসা। রাজ্যের বিধানসভা ভোটে শূন্য আসন পাওয়া থেকে শুরু করে লোকসভায়ও একই অবস্থা—এই সমস্ত কিছু সিপিএমের সাংগঠনিক শক্তি এবং জনসমর্থনের অভাবকে তুলে ধরে। কিন্তু সাম্প্রতিক আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে ঘটে যাওয়া ন্যক্কারজনক ঘটনাটি সিপিএমকে নতুন করে উজ্জীবিত করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।

ঘটনার প্রেক্ষাপট চলতি বছরের ৯ আগস্ট আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের মহিলা ডাক্তার খুন ও ধর্ষণের ঘটনা। যা রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে গোটা দেশকে নাড়া দিয়েছে। এই ঘটনার পর সিপিএম দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানিয়ে রাজ্যে প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু করে। শিক্ষিক, ছাত্র, যুব থেকে সমস্ত স্তরের সাধারণ নাগরিকদের একত্রিত করে তারা এই ঘটনার বিরুদ্ধে তীব্র আওয়াজ তুলেছে। সেইসঙ্গে তারা রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার অভিযোগ তোলে। এই ঘটনা তাদের জন্য একটি নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে, যা গত এক দশকে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।

CPIM3

এমনিতে সিপিএমের ইতিহাসে আন্দোলন একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে। শুরু থেকেই তাদের আন্দোলন কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট। ১৯৬০-এর দশকে কৃষকদের জমির অধিকার, শ্রমিকদের মজুরি এবং শ্রম আইন সংস্কারের দাবিতে সংগঠিত আন্দোলন তাদের রাজনীতির ভিত্তি স্থাপন করে। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে সিপিএমের নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলন এবং শ্রমিক আন্দোলনগুলো একটি শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। সেই জায়গায় আরজি কর আন্দোলনকে সামাজিক আন্দোলন বললেও অত্যুক্তি হবে না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বামপন্থী দলের আন্দোলনগুলি সে ভাবে জোরালো বা দীর্ঘমেয়াদি ছিল না। কিন্তু আরজি কর কাণ্ডের পর, সিপিএম নতুন করে উজ্জীবিত হয়েছে। দলের তরফে রাজ্য জুড়ে মিছিল, সমাবেশ, এবং সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার শুরু হয়েছে। তারা এই ঘটনার প্রসঙ্গ তুলে ধরার মাধ্যমে নারী নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য পরিষেবা, বিভিন্ন সরকারি বিভাগের দুর্নীতি এবং সরকারের দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।

তবে, এই আন্দোলন শুধুমাত্র সিপিএমের জন্য একটি সুযোগ নয়, বরং এটি তাদের জনগণের সঙ্গে সংযোগ বাড়ানোরও একটি পথ প্রশস্ত করে দিয়েছে। রাজ্যের যুব সমাজ এবং নারীরা যখন একত্রিত হয়ে এই ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল হয়, তখন সিপিএম সেই তরুণদের আকৃষ্ট করতে পারে। তাদের উপস্থিতি এবং আন্দোলনের বিষয়বস্তু অনেক যুবকের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করেছে, যা সিপিএমের জন্য একটি নতুন সম্ভাবনার আলো দেখাচ্ছে। দলের ডাকে ব্রিগেড ভরা আর সাধারণ মানুষের তাগিদে তাদের রাস্তায় নামানোর মধ্য়ে ফারাক তো যথেষ্টই বটে!

যদিও বিষয়টা এতটাই জলবত তরলং নয়, এর মধ্যে চ্যালেঞ্জও রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিবেশে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপির আধিপত্যের ফলে সিপিএমের প্রভাব কমেছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের চাপ, অর্থনৈতিক সংকট এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ফলে তাদের আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ফলে, তাদের এই আন্দোলন শুধুমাত্র একটি ঘটনাকে (আরজি কর) কেন্দ্র করেই প্রাসঙ্গিক থাকবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। সিপিএম যদি তাদের সংগঠনকে শক্তিশালী করতে এবং নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছাতে চায়, তবে তাদের আরও কার্যকরভাবে কাজ করতে হবে। নিজেদের আন্দোলন ঐতিহ্যকে ধরে রেখে জনগণের সমস্যা সমাধানে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে হবে।

এর জন্য চাই সুনির্দিষ্ট ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আরজি কর কাণ্ড সিপিএমের জন্য একটি নতুন দিশা দেখাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তারা যদি এই আবহে যুব এবং মহিলাদের পাশে নিয়ে তাদের আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করতে সফল হয়, তবে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা রয়েছে। এর জন্য একটি সুস্পষ্ট এবং কার্যকর পরিকল্পনা নিয়ে সামনে আসতে হবে, যাতে তারা নির্বাচনী রাজনীতিতে পুনরায় প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারে।

এ কথা অনস্বীকার্য, সিপিএমের ভবিষ্যৎ এখন আরজি কর আন্দোলনের ওপর নির্ভর করছে অনেকটাই। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে তারা যদি জনগণের আশা এবং আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে, তবে তারা বঙ্গ-রাজনীতিতে আবারও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে সক্ষম হবে। সবমিলিয়ে ইতিহাসের এই মোড়ে দাঁড়িয়ে, সিপিএমের জন্য সময় এসেছে নতুন করে জেগে ওঠার এবং একটি নতুন রাজনীতির দিশা রচনার।

ছবি: রাজীব বসু

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version