Home প্রবন্ধ স্বাধীনতা আন্দোলনের অলিখিত ইতিহাস: মদনলাল ধিংড়ার আত্মবলিদান  

স্বাধীনতা আন্দোলনের অলিখিত ইতিহাস: মদনলাল ধিংড়ার আত্মবলিদান  

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

এই ইতিহাস সেই অগ্নিযুগের প্রথম পর্বের কাহিনি।

পরাধীন ভারতবর্ষের বুকে শুরু হয়ে গিয়েছে অগ্নিশ্রীমান, অগ্নিশ্রীময়ী বীর বিপ্লবীদের ‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন…’-এর অদম্য আগ্রহের মানসিকতায় দেশমাতৃকার জন্যে সশস্ত্র বিপ্লবের আত্মাহুতিতে নিবেদিত আত্মবলিদানের যজ্ঞ।

না, তখনও দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমিতে গান্ধী, নেহরু, পটেল প্রমুখ বিন্দুমাত্র নেই। সারাদেশে তখন প্রতিবাদের বৈপ্লবিক ধারার জন্ম হয়ে গিয়েছে। দীর্ঘদিনের নানান অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে প্রয়োজনে নিজের জীবন দিতেও প্রস্তুত ভারতমায়ের আগুনমুখী সেই সব মৃত্যুঞ্জয়ী সন্তানরা।

এর মধ্যেই মহারাষ্ট্রের পুণের চাপেকারদের তিন ভাই দামোদরপন্থ হরি, বালকৃষ্ণ হরি এবং বাসুদেব হরি ১৮৯৯ সালেই ফাঁসির দড়িতে প্রাণ দিয়েছেন। শহিদ হয়েছেন বিনায়ক রানাড়ে। ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গেয়ে আত্মবলিদান দিয়েছেন বঙ্গসন্তান প্রফুল্ল চক্রবর্তী, প্রফুল্ল চাকী, ক্ষুদিরাম বসু প্রমুখ আরও অনেকে – কোথায় এর শেষ, তা কে জানে।

ব্রিটিশ পুলিশ গোয়েন্দারা ভারতীয় তরুণ, যুবকদের সন্দেহের চোখে দেখতে লাগল। শুরু হয়েছিল নানান অজুহাতে দেশে-বিদেশে ভারতীয় ছাত্রসমাজের ওপরে নজরদারি, তাদের নানা রকম ভাবে হেনস্তা করা, আত্মসম্মানে আঘাত করা, মিথ্যে অপবাদ দেওয়া, চরিত্রহনন করা ইত্যাদি – ধারাবাহিক মানসিক শারীরিক অত্যাচার।

আর দেশের বাইরে বিশেষ করে এই কাজের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল মি. কার্জন উইলিকে। এই মি. উইলি তখন ব্রিটিশ ভারতের বিদেশ সচিবের (সেক্রেটারি অফ স্টেট) রাজনৈতিক উপদেষ্টা (পলিটিক্যাল এডিসি)। খাতায়কলমে মি. উইলির কাজ হল বিদেশে যে সকল ভারতীয় ছাত্র রয়েছেন, তাঁদের দেখাশোনা করা। কিন্তু আসলে তলেতলে গোয়েন্দার কাজ করা। তাঁদের কোনো স্বাধীনতা দেওয়া যাবে না। ব্রিটিশ সরকারের হুকুম, দরকারে তাদের ধরপাকড় করতে হবে, মিথ্যে মামলায় ফাঁসাতে হবে। অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল বিলেতে, ইউরোপে থাকা ভারতীয় ছাত্রসমাজ। প্রতি পদক্ষেপে সন্দেহ, জবাবদিহি, কৈফিয়ত চাওয়া ইত্যাদি।

ভারত থেকে ১৯০৬ সালে বিলেতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যাওয়া এক পঞ্জাবি তরুণ তাঁর তিক্ত অভিজ্ঞতায় মনে মনে স্থির করলেন, এর একটা বিহিত করতেই হবে।

কে সেই তরুণ?

সেই তরুণ অবিভক্ত পঞ্জাবের অমৃতসরের বিখ্যাত, বিরাট ধনী এবং ব্রিটিশ সরকারের অত্যন্ত প্রিয় ‘ধিংড়া’ পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তান, নাম মদনলাল। ১৮৮৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর (মতান্তরে ফেব্রুয়ারি) তাঁর জন্ম। বাবার নাম ডাক্তার দিত্তালাল ধিংড়া। মদনলালের ওপরের ছয় ভাইয়ের তিন ভাই বিলেতফেরত ডাক্তার, অপর তিনভাই বিলেত থেকেই পাশ করা ব্যারিস্টার (বার-অ্যাট-ল)। আর এ হেন পরিবারের ছোটো ছেলে মদনলাল পঞ্জাবে এন্ট্রান্স পাশ করে বিলেতে গেছেন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে।

অবশ্য ব্রিটিশঘনিষ্ঠ ধিংড়া পরিবারের এই ছোটো ছেলেটি ভারতে থাকার সময়েই পঞ্জাবের বিপ্লবী সর্দার অজিত সিং-এর (শহিদ ভগৎ সিং-এর কাকা) কাছে স্বদেশপ্রেমে দীক্ষা নিয়ে নিয়েছেন। বুকের মধ্যে দেশমাতৃকার জন্য নিবেদিত মানসিক ইচ্ছা, স্থিরীকৃত ইস্পাত-কঠিন প্রতিজ্ঞা।

১ জুলাই, ১৯০৯। লন্ডনের প্রাণকেন্দ্রে বিখ্যাত জাহাঙ্গীর হল। সেখানেই সে দিন ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বিভিন্ন বয়সের নর-নারীর ঠাসা ভিড়ে জমজমাট প্রেক্ষাগৃহ। হ্যাঁ, সেখানে বিশিষ্টজনেদের মধ্যে উপস্থিত মি. কার্জন উইলি-ও।

উদ্বোধনী সংগীত শেষ হল। এ বার শুরু হবে অন্যান্য অনুষ্ঠান। খুব স্বাভাবিক ভাবেই ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন আভিজাত্যপূর্ণ ইংরেজ পোশাকে সজ্জিত এক যুবক মি. উইলির খুব কাছে। আর সঙ্গে সঙ্গেই গর্জে উঠল আগ্নেয়াস্ত্র – দ্রাম! দ্রাম! দ্রাম! অত্যাচারী শয়তান মি. উইলি তখন শেষ। তাঁর সঙ্গে উইলিকে বাঁচাতে আসা মি. ল্যালকাকা নামের একজন পারসি ব্যক্তিও মাটিতে পড়ে রয়েছেন।

madanlal dhingra 08.08

না, সে দিন মদনলাল সেই ঘটনা ঘটিয়ে পালিয়ে যাননি। অবিচল শান্ত ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ব্রিটিশ পুলিশ রিভলবার তাক করে তাঁর কাছে এসে তাঁকে গ্রেফতার করল। মদনলালের চোখে-মুখে, আচারে-আচরণে এক অনন্যসাধারণ স্থিরতা, সংযত ভাব। সত্যিই অবাক করার মতো।

১০ জুলাই পুলিশের হেফাজত থেকে ধিংড়াকে হাজির করানো হল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। ম্যাজিস্ট্রেটের প্রশ্নের উত্তরে সে দিন সেই আদালতে দাঁড়িয়ে মদনলাল ধিংড়া নির্ভীক বলিষ্ঠতায় যে উক্তি করেছিলেন, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে আজও তা অম্লান অক্ষয় হয়ে আছে। তিনি বলেছিলেন: “জার্মানদের যেমন ব্রিটেন দখল করার কোনো অধিকার নেই, ব্রিটেনেরও তেমনি আমার জন্মভূমি ভারতবর্ষকে দখলের কোনো এক্তিয়ার, কোনো অধিকার নেই। যে ইংরেজ আমার জন্মভূমি ভারতবর্ষকে অপবিত্র করতে চায়, তাকে হত্যা করা আমাদের কাছে ন্যায়ের নির্দেশ। ইংরেজের কপটতা, অশোভন মিথ্যাচার এবং বিদ্রূপাত্মক, বিদ্রূপবর্ষী আচরণ দেখে আমি স্তম্ভিত।”

এখানেই থামেননি বিপ্লবী মদনলাল, তিনি সে দিন ওল্ড বেইলির আদালতে দাঁড়িয়ে দৃপ্তকন্ঠে বলেছিলেন: “I believe that a nation held down by foreign bayonet is in a perpetual state of war, since open battle is rendered impossible to a disarmed race. I attacked by suprise; since guns were denied me, I drew forth my pistol and fired.” (আমি বিশ্বাস করি, বিদেশি বেয়নেটের চাপে দাবিয়ে রাখা একটা জাতি নিয়ত যুদ্ধরত থাকতে বাধ্য হয়। কিন্তু নিরস্ত্র জাতির প্রকাশ্য যুদ্ধের সুযোগ নেই। তাই আমি আচমকা আমার শত্রুকে আক্রমণ করেছি। যে হেতু বন্দুকের লাইসেন্স আমাকে দেওয়া হবে না, তাই গর্জে উঠেছে আমার পিস্তল।)

সে দিন আরও বলেছিলেন মদনলাল ধিংড়া: “Poor in wealth and intellect, a son like myself has nothing else to offer to The Mother but his own blood, and so I have sacrificed the same on her alter.” (সম্পদহীন ও মেধাহীন আমার মতো এক সন্তানের মাকে দেওয়ার আর কী আছে নিজের রক্ত ছাড়া! তাই তাঁর বেদীমূলে নিজেকে উৎসর্গ করেছি।)

সে দিন মদনলাল ধিংড়া তাঁর বক্তব্যে আদালতের উপস্থিত সকলকে, এমনকি খোদ ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকেও হতবাক করে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন: “The only lesson required in India at present is to learn how to die and the only way to teach it is by dying ourselves. Therefore I die, and glory in my martyrdom.” (ভারতবর্ষে বর্তমানে একটিমাত্র শিক্ষাই দরকার, তা হল মৃত্যুবরণের শিক্ষা এবং এটা শেখার একটাই উপায় এবং তা হল নিজে মৃত্যুবরণ করা। তাই আমি নিজে মৃত্যুবরণ করছি এবং আমার শহিদত্বে গর্ব করছি।)

কী অপূর্ব বলিষ্ঠ এবং টানটান শিরদাঁড়ায় কথাগুলি আজ থেকে ১০০ বছরেরও আগে উচ্চারণ করেছিলেন খোদ ব্রিটিশ শাসকের নিজস্ব জায়গায় দাঁড়িয়ে। তখন আমাদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে তথাকথিত কংগ্রেস, গান্ধী, নেহরু, পটেল প্রমুখ, যাঁদের নামের সঙ্গে পরবর্তী কালে আমরা পরিচিত হয়েছি, এই বিপ্লবীদের ধারেকাছেই ছিলেন না। কিন্তু আমাদের দেশের ইতিহাসের পাতায়  উপেক্ষিতই রয়ে গেল মদনলাল ধিংড়াদের মতো বিপ্লবী দেশপ্রেমিকদের আত্মবলিদানের অনন্যসাধারণ কাহিনি।

সে দিন আদালতে দাঁড়িয়ে ধিংড়া সবশেষে বিধাতার কাছে জানিয়েছেন তাঁর অন্তিম ইচ্ছা এবং প্রার্থনা – “My only prayer to God is may I be re-born of the same Mother and I may re-die for the same sacred cause till the cause is successful…” (আমার একমাত্র কামনা আমি যেন আবার একই মায়ের কোলে জন্মগ্রহণ করে সেই পবিত্র উদ্দেশ্যে আবার মৃত্যুবরণ করি, যত দিন না সেই উদ্দেশ্য সফল হয়।)

এক শতাব্দীর পরেও মদনলাল ধিংড়ার সেই স্বপ্ন আজও অধরাই রয়ে গিয়েছে। ভারতবর্ষের মানুষ হয়তো ভুলে গিয়েছেন স্বাধীনতা আন্দোলনের এই বীর শহিদের নাম। সে দিন ফাঁসির দড়ি কন্ঠ স্তব্ধ করে দিলেও মদনলাল ধিংড়ার সেই আত্মবলিদান, আজও ইতিহাসের পাতায় অম্লান।

বিশ্ববিখ্যাত ঐতিহাসিক ডব্লিউ এস ব্লান্ট তাঁর একটি গ্রন্থ ‘মাই ডায়েরিজ’-এ (My Diaries০ লিখেছেন – “কোনো খ্রিস্টান শহিদই মি. ধিংড়ার চাইতে অধিক নিঃশঙ্কতায় ও মাহাত্ম্যে আদালতে বিচারকের সামনে দাঁড়াতে পারেননি। মি. ধিংড়ার ‘শহিদের মৃত্যুদিন’ ভারতবর্ষে আবহমানকাল শহিদ-তর্পণের পবিত্রতায়, বিনম্রতায় পালিত হবে।…পৃথিবীখ্যাত রাজনৈতিক নেতা মি. লয়েড জর্জ পর্যন্ত মি. চার্চিলের কাছে সে দিন বলেছিলেন, ‘মি. ধিংড়ার কোর্ট-এ প্রদত্ত বিবৃতি দেশপ্রেমের শ্রেষ্ঠতম মাধুর্যে উজ্জ্বল। তার তুলনা চলে শুধু ‘প্লুটার্ক’-এর মতো মৃত্যুঞ্জয়ী বীর বিপ্লবীর সঙ্গে।”

মদনলাল ধিংড়া ১৯০৯-এর ১৭ আগস্ট ব্রিটেনের এইচ এম পি পেন্টিভেলি কারাগারে ফাঁসির দড়িতে নিজের প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন। ফাঁসির ঠিক আগে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন সেই বিপ্লবী মন্ত্র: বন্দেমাতরম, বন্দেমাতরম।

ভারববর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে বিদেশের মাটিতে প্রথম শহিদ হন বীর বিপ্লবী মদনলাল ধিংড়া।

তথ্যসূত্র:

ভারতে সশস্ত্র বিপ্লব – ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত রায়

আমি সুভাষ বলছি – শৈলেশ দে

My Diaries – Wilfrid Scawen Blunt

স্বাধীনতা আন্দোলনের অলিখিত ইতিহাস: সত্যবতীর কথা

স্বাধীনতা আন্দোলনের অলিখিত ইতিহাস: জালালাবাদে আত্মবলিদান

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version