Home প্রবন্ধ স্বাধীনতা আন্দোলনের অলিখিত ইতিহাস: জালালাবাদে আত্মবলিদান

স্বাধীনতা আন্দোলনের অলিখিত ইতিহাস: জালালাবাদে আত্মবলিদান

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

প্রশ্ন জাগে ইতিহাসের পাতায়, তা হলে কি গভীর চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ছিল অবিভক্ত ভারতবর্ষকে টুকরো টুকরো করার? আসলে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দিতেই কি এই দেশভাগ? কারণ আজ আমরা ক’জন জানি, চট্টগ্রামের জালালাবাদের কথা? কী ঘটেছিল সেখানে পরাধীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে? বোধহয় আমরা খবরই রাখি না। আর রাখবই বা কী করে?  

মহাত্মা গান্ধী আর জওহরলাল নেহরুকে সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন, কোনো ভাবেই যেন ইংরেজের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে জন্মভূমি ভারতবর্ষকে ভাগ করা না হয়। কিন্তু সে দিন কেউ শোনেনি তাঁর কথা। নিজেদের ভাগ-বাঁটোয়ারায় নেতা-নেত্রীরা ব্যস্ত ছিলেন। সে এক চরম ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের কলঙ্কিত ইতিহাস।

যাক সে কথা। কী ঘটেছিল জালালাবাদে?

১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল – চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন করলেন ভারতমায়ের অকুতোভয় বিপ্লবী বীর যোদ্ধারা। ব্রিটিশ শাসকের কর্তাব্যক্তিরা, এই বাংলা থেকে শুরু করে গোটা ভারতবর্ষ, এমনকি সুদূর খোদ ইংল্যান্ডে বসেও থরহরি কম্পমান। ব্রিটিশ শাসকের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন সে দিন মাস্টারদা সূর্য সেন এবং তাঁর সহযোদ্ধা বিপ্লবীরা। ব্রিটিশ সরকার উন্মাদ হয়ে গিয়ে শুরু করল অত্যাচার। এলোপাতাড়ি তল্লাশির নামে, জিজ্ঞাসাবাদের নামে চলল খানাতল্লাশি, চলল গুলি, চলল চোরাগোপ্তা খুনখারাপি, চলল অকথ্য মারের অত্যাচার। সারাদেশের মানুষের কাছে সে সব খবর গোপন করে রাখা হল।

ও দিকে সূর্য সেন-সহ বিপ্লবীরা পায়ে হেঁটে পেরিয়ে গিয়েছিলেন চট্টগ্রাম, সিলেট হয়ে জালালাবাদের পাহাড়ি উপত্যকায়। এতটা পথে তাঁদের জোটেনি খাবার। হ্যাঁ, তাঁরা খেয়েছেন – তেঁতুলপাতা, কচি আম, মাটির ঘাস, পথে পড়েছিল চাষের খেত, সেখান থেকে তরমুজ ইত্যাদি। সারা রাত পায়ে হন্টন, আর দিনের আলোয় পাহাড়ি কোনো জায়গাতে লুকিয়ে থাকা। কয়েক জন ঘুমিয়ে নিলে, বাকিরা পাহারায় সজাগ থেকে নজরদারি করতেন।

২১ শে এপ্রিল, বিপ্লবী অমরেন্দ্র নন্দীকে পাঠানো হল সমতলে কী ঘটছে, না ঘটছে, সেই খবর গোপনে আনার জন্য। অমরেন্দ্র চট্টগ্রাম, সিলেট, এই জালালাবাদ অঞ্চলটিকে হাতের তালুর মতো চিনতেন, জানতেন। কিন্তু তিনি আর ফিরলেন না। তাঁকে সন্দেহ করতে শুরু করেছিলেন কেউ কেউ। তাই পুলিশের হাতে ধরা পড়ার আগেই অমরেন্দ্র আত্মহত্যা করে শহিদের মৃত্যুবরণ করেন।

সবাই তখন জালালাবাদ পাহাড়ের গোপন গুহার মধ্যে লুকিয়ে আছেন। হঠাৎ দু’জন সন্দেহভাজন লোককে দেখা গেল পাহাড়ে ঘোরাফেরা করতে। তাদের জিজ্ঞাসা করতে তারা নিজেদের পরিচয় দিল রাখাল বলে। যদিও বোঝাই যাচ্ছিল, তারা রাখাল নয়, পুলিশের চর, তবু তাদের ছেড়ে দেওয়া হল মাস্টারদার নির্দেশে।

২২ এপ্রিল, ১৯৩০ – ব্রিটিশ পুলিশ, সেনাবাহিনী জালালাবাদ পাহাড়টিকে ঘিরে ফেলল। জালালাবাদ পাহাড়ের ওপরে গোপন কন্দরে লুকিয়ে রয়েছেন বিপ্লবীরা, আর তাঁদের ঘিরে রয়েছে ব্রিটিশ পুলিশ। শুরু হল যুদ্ধ।

freedom story 2 harigopal 05.08 1

১৩ বছরের শহিদ হরিগোপাল বল তথা টেগরা বল।

পাহাড়ের আড়াল থেকে, আবডাল থেকে, গাছের আড়াল থেকে লড়ছেন ভারতমায়ের বীর বিপ্লবী সন্তানরা। হঠাৎ একটা আর্তনাদ – “উফ্ মাগো…”, পড়ে গেল রক্তাক্ত অবস্থায় ১৩ বছরের বালক হরিগোপাল বল, যার ডাক নাম ‘টেগরা বল’। তার শেষ কথা (তার নিজের দাদা ক্যপ্টেন লোকনাথ বলের উদ্দেশে) – “রাঙাদা, আমি চললাম, তোমরা থেমো না।” না থামেননি সে দিন বিপ্লবীরা। মরণপণ নিয়ে ইন্ডিয়ান রিপাবলিক আর্মির বিপ্লবীরা লড়েছিলেন যুদ্ধ।

চলছে লড়াই। বিপ্লবীদের গুলিতে একের পর এক ব্রিটিশ পুলিশ, সেনারা ধরাশায়ী হচ্ছে। পরে পুলিশ কমিশনার মি. চার্লস টেগার্ট স্বীকার করেছিলেন, সে দিন জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর প্রায় ১০০ জন নিহত হয়েছিল বিপ্লবীদের আক্রমণে।

কিন্তু আমাদেরও অনেক বিপ্লবী সে দিন সেই যুদ্ধে তাদের তরতাজা বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন। যাঁরা সে দিন শহিদ হয়েছিলেন তাঁরা হলেন হরিগোপাল (টেগরা) বল, নির্মল লালা, নরেশ রায়, বিভু ভট্টাচার্য, জিতেন দাশগুপ্ত, ত্রিপুরা সেন, পুলিন ঘোষ, শশাঙ্ক দত্ত, মধু দত্ত ও মতিলাল কানুনগো। প্রায় দু’-তিন ঘণ্টা লড়াইয়ের পরে ব্রিটিশ সেনা ও পুলিশ সেই স্থান ছেড়ে চলে যায়।

এ দিকে বিপ্লবীদের মধ্যে যাঁরা সে দিন তখনও জীবিত ছিলেন, তাঁরা একটা একটা করে তাঁদের অতিপ্রিয় সহযোগীর মৃতদেহ নিয়ে এসে এক জায়গাতে পরম যত্নে শুইয়ে রাখলেন। মাস্টারদা তাঁদের বুকের ওপরে মুখ নিয়ে গিয়ে কান পেতে দেখছেন, যদি শ্বাসপ্রশ্বাস শুনতে পান, যদি প্রাণ থাকে দেহে।

পরম মমতায় বারবার হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন মৃত সাথি-শহিদদের চোখে, মুখে, গায়ে, মাথায়। এইরকম অনেকক্ষণ চলার পরে মাস্টারদা সূর্য সেন সামরিক কায়দায় শহিদদের অন্তিম অভিবাদন জানিয়ে শ্রদ্ধা জানালেন। অন্যরাও তাই করলেন। মুখে উচ্চারণ করলেন ‘বন্দে মাতরম’, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’।

তার পর সূর্য সেন ধীরে ধীরে বললেন, “চলো, এবার সবাই। আজ সন্ধের পরই এই পাহাড় ছাড়তে হবে। আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে হবে। সবাই আলাদা আলাদা, একসাথে নয়।” এই বলে আর পিছনে তাকালেন না। এগিয়ে চললেন। তখন হয়তো বিপ্লবীদের মনের মধ্যে অনুভুতিতে অনুরণিত হচ্ছে – “সরফরোশি কি তমান্না অব হমারে দিল মে হ্যায়…”।

সে দিনের দেশমাতৃকার সেই ১৩ জন শহিদ-বিপ্লবী সন্তান তাঁদের স্বাধীন মাতৃভুমির স্বপ্ন নিয়ে জালালাবাদ পাহাড়ের বুকেই রয়ে গেলেন চিরকালের জন্য। আজ কেউ সেখানে আর তাঁদের স্মৃতিতর্পণ করেন না। অবশ্য সেই পবিত্র তর্পণের সুযোগটাই তো দেশের নেতা-নেত্রীরা দেশটাকে ভাগ করে সব চিরতরে শেষ করে দিয়েছেন। আমাদের মন থেকে মুছেই দিতে চেয়েছেন স্বাধীনতা আন্দোলনের সত্য ইতিহাস।

কিন্তু না, তাঁরা তা কখনোই পারবেন না। সত্যের জয় হবেই হবে।

সে দিন জালালাবাদ যুদ্ধের পরে বিভিন্ন জায়গা থেকে গ্রেফতার হয়েছিলেন বিপ্লবী লোকনাথ বল, অম্বিকা চক্রবর্তী, রামকৃষ্ণ ঘোষ দস্তিদার, গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ, মাস্টারদা সূর্য সেন প্রমুখ।

বিচারের নামে অত্যাচার চলেছিল অমানুষিক ভাবে। ব্রিটিশের সবচেয়ে বেশি আক্রোশ ছিল মাস্টারদা সূর্য সেনের উপর। এক বিশ্বাসঘাতক নেত্র সেন ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে সূর্য সেনের গতিবিধি পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছিল। সূর্য সেন গ্রেফতার হন। সেই সঙ্গে গ্রেফতার হন তারকেশ্বর দস্তিদার। যদিও পরে সেই নেত্র সেনের শিরশ্ছেদ করে দিয়েছিলেন বিপ্লবী গোকুল সেন।

যা-ই হোক, সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের উপর অকথ্য অত্যাচার করেছিল সে দিন ব্রিটিশ পুলিশ। তাঁদের হাতের, পায়ের নখ সাঁড়াশি দিয়ে উপড়ে ফেলা হয়। দাঁতগুলি হাতুড়ি দিয়ে মেরে মেরে ভেঙে দেওয়া হয়। সারা বুকে, পেটে, পিঠে, তলপেটে ভারী বুটের লাথি মেরে মেরে দু’জনকে সূর্য সেনকে প্রায় মৃত করে ফেলা হয়। তার পর সেই প্রায় মৃতদেহদুটিকে টেনে হিঁচড়ে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।

সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের মৃতদেহ আত্মীয়দের হাতে তুলে দেওয়া হয়নি বা হিন্দু সংস্কার অনুযায়ী পোড়ানোও হয়নি। ফাঁসির পরে দেহদুটি জেলখানা থেকে ট্রাকে করে ৪ নম্বর স্টিমারঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। তার পর ব্রিটিশ ক্রুজার ‘দ্য রিনাউন’-এ তুলে নিয়ে বুকে লোহার টুকরা বেঁধে বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগরের সংলগ্ন একটা জায়গায় ফেলে দেওয়া হয়। এই হল সুসভ্য নরাধম ব্রিটিশ শাসকের সভ্যতা-ভব্যতার পরিচয়।

অন্য বিপ্লবীদের দ্বীপান্তর হয়। পাঠিয়ে দেওয়া হয় আন্দামানের সেলুলার জেলে।

এই স্বল্প পরিসরে জালালাবাদ পাহাড়ের সেই যুদ্ধের কাহিনি, সংগ্রামের ইতিহাস লেখা অতি দুরূহ কাজ। তাই এই অতি সংক্ষিপ্ত কাহিনির পদপ্রান্তে নতজানু হয়ে স্মরণ করতে ইচ্ছে হয়, ইচ্ছে হয় আমাদের জন্মভূমির প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা জানাতে, যে আজও সঠিক পথের সন্ধান, সঠিক পথের ঠিকানা আমরা খুঁজে চলেছি।

খুঁজে নিতে হবে সেই ঠিকানা – সে কথাই বহু দিন আগে বলে গিয়েছেন তাঁর লেখনীতে বিপ্লবী কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য – “ঠিকানা আমার চেয়েছো বন্ধু/ ঠিকানার সন্ধান,/ আজও পাও নি? দুঃখ যে দিলে করব না অভিমান?/…বন্ধু, তোমার ভুল হয় কেন এত?/ আর কতদিন দুচক্ষু কচলাবে,/ জালিয়ানওয়ালায় যে পথের শুরু/ সে পথে আমাকে পাবে,/ জালালাবাদের পথ ধ’রে ভাই ধর্মতলার পরে,/ দেখবে ঠিকানা লেখা প্রত্যেক ঘরে,/ ক্ষুব্ধ এদেশে রক্তের অক্ষরে।/ বন্ধু আজকে বিদায়!/ দেখেছ উঠল যে হাওয়া ঝোড়ো,/ ঠিকানা রইল,/ এবার মুক্ত স্বদেশেই দেখা ক’রো।”

তথ্যসূত্র:

আমি সুভাষ বলছি – শৈলেশ দে।

জেলে ত্রিশ বছর – ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী।

উইকিপিডিয়া।

আরও পড়ুন

স্বাধীনতা আন্দোলনের অলিখিত ইতিহাস: সত্যবতীর কথা  

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version