পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
ওঁরা রফিক-সালাম। এঁরাও রফিক-সালাম। ওঁরা প্রাণ দিয়েছিলেন মাতৃভাষার মর্যাদারক্ষায় আর এঁদের কৃতিত্ব সেই দিনটিকে আন্তর্জাতিক স্তরে স্মরণীয় করে রাখার জন্য। এঁরা কানাডার ভ্যানকুভার শহরের রফিকুল ইসলাম আর আবদুস সালাম।
মানুষ যাতে নিজেদের মাতৃভাষার গুরুত্ব বোঝে, মাতৃভাষা সম্পর্কে সচেতন হয়, তার সম্মানরক্ষায় সক্রিয় হয়, তার জন্য কাজ করে চলেছে ‘আ গ্রুপ অফ মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ তথা ‘বিশ্ব মাতৃভাষাপ্রেমী সংস্থা’। এদেরই উদ্যোগে ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের বার্সেলোনা অধিবেশনে ভাষার অধিকারকে ‘বিশ্বজনীন অধিকার’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়। এই সংস্থারই অন্যতম সদস্য রফিকুল ইসলাম। মাতৃভাষার মর্যাদার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটেছিল, কী ভাবে রফিক-সালাম-বরকতরা নিজেদের জীবন দিয়েছিলেন, তার ইতিহাস বিধৃত করে রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব কোফি আন্নানকে ১৯৯৮ সালের ৯ জানুয়ারি একটি প্রস্তাব পাঠান রফিকুল। ওই প্রস্তাবে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। প্রস্তাবটিতে পৃথিবীর সাতটি দেশের দশ জন ভাষাপ্রেমিকও সই করেন। এঁদের মধ্যে এক জন হলেন আবদুস সালাম। সেই সময়ে সাহিত্যিক হাসান ফিরদৌস রাষ্ট্রপুঞ্জের চিফ ইনফরমেশন সেক্রেটারি ছিলেন। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর নজরে আসে প্রস্তাবের আকারে ওই চিঠি। রাষ্ট্রপুঞ্জের অন্য কোনো সদস্যরাষ্ট্রের কাছ থেকে যাতে একই ধরনের প্রস্তাব আসে তার জন্য উদ্যোগী হতে হাসান ফিরদৌস ১৯৯৮ সালের ২০ জানুয়ারি ওই ভাষাপ্রেমিকদের অনুরোধ করেন। সেই সময় ‘বিশ্ব মাতৃভাষাপ্রেমী সংস্থা’ থেকে এক জন জার্মানভাষী, এক জন ইংরেজিভাষী, এক জন স্প্যানিশভাষী এবং এক জন ক্যান্টোনিজভাষী ওই একই প্রস্তাব চিঠি আকারে কোফি আন্নানের কাছে পাঠান। ওই চিঠির একটি কপি পাঠানো হয় রাষ্ট্রপুঞ্জে কানাডার রাষ্ট্রদূত ডেভিড ফাওলারের কাছেও।
হাসান ফিরদৌস পরের বছর রফিক-সালামদের বলেন, তাঁরা যেন ইউনেস্কোর ভাষা বিভাগের জোসেফ পড-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি ইউনেস্কোর অ্যানা মারিয়ার সঙ্গেও যোগাযোগ করতে বলেন। সেইমতো মারিয়ার সঙ্গে দেখা করেন রফিক-সালামরা। রফিক-সালামদের বক্তব্য আগ্রহের সঙ্গে শোনেন মারিয়া, প্রস্তাবটি পড়েন এবং এই প্রস্তাব কানাডা, ভারত, বাংলাদেশ, হাঙ্গেরি, স্পেন ও ফিনল্যান্ডের মাধ্যমে পেশ করার পরামর্শ দেন। বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন জনের কাছে ওই প্রস্তাবটি পেশ করা হল ‘বিশ্ব মাতৃভাষাপ্রেমী সংস্থা’র তরফে। ফলে আরও অনেকে যুক্ত হন সেই কর্মকাণ্ডে। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাংলাদেশের তদানীন্তন শিক্ষামন্ত্রী এম এ সাদেক, শিক্ষাসচিব কাজী রফিকুদ্দিন, অধ্যাপক কফিলউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়ের তৎকালীন অধিকর্তা মশিউর রহমান, ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মোজাম্মেল আলি, ইউনেস্কোর সেক্রেটারি জেনারেলের প্রধান উপদেষ্টা তোজাম্মেল হক প্রমুখ। তাঁরা তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমে পৃথিবীর আরও ৩০টি দেশকে রাজি করালেন প্রস্তাবটি সমর্থন করার জন্য। ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে যাওয়ার জন্য কয়েক জন দৃঢ়চেতা বাঙালি নিরলস পরিশ্রম করে গিয়েছেন। ১৯৯৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর সম্বলিত প্রস্তাবটি অন্যান্য ৩০টি দেশের সমর্থন নিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জে পাঠানো হল।
এ বার অপেক্ষা ১৯৯৯-এর ১৬ নভেম্বরের জন্য। সেই দিন ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে প্রস্তাবটি পেশ হওয়ার কথা। দীর্ঘ অতন্দ্র অপেক্ষার পর এল সেই দিন। কিন্তু হায়, এক অজানা অবোধ্য কারণে সে দিন পেশ হল না প্রস্তাবটি। তবে পরের দিনই প্রস্তাব পেশ হল। এবং অধিবেশনে উপস্থিত ১৮৮টি দেশ সমর্থন করল প্রস্তাবটি। ২১ ফেব্রুয়ারি স্বীকৃতি পেল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের। ২০০০ সাল থেকে পৃথিবীর প্রতিটি দেশ ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখে মাতৃভাষা দিবস পালন করে আসছে। ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপুঞ্জ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালন করার প্রস্তাব সর্বসম্মত ভাবে পাশ হয়।
ভৌগোলিক-রাজনৈতিক-সাম্প্রদায়িক সীমানা পেরিয়ে আমাদের ভাষা, আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি, আমাদের ঐতিহ্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এখন প্রতিষ্ঠিত, সম্মানিত, সমাদৃত। আমাদের এ বুকে অনির্বাপিত আলোকবর্তিকার নাম ‘একুশে’; আমাদের বর্ণমালার প্রথম পাঠ ‘একুশে’; আমাদের মায়ের হাতের সাঁঝের বাতি, রক্তাক্ত ভায়ের স্মৃতি ‘অমর একুশে’; আমাদের গুমরে ওঠা বুকের ব্যথা – কাব্যকথা – নকশিকাঁথার মাঠ, তার নাম ‘অমর একুশে’; আমাদের ভাদু-ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালি, আউল-বাউল-লালন-সিরাজ-হাসন রাজায় সুর তোলে ‘অমর একুশে’। ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের পথ দেখায়। বুকের রক্তনদী ঢেলে যাঁরা ২১-কে আগামীর কাছে রেখে গেলেন, বাংলা ভাষাকে পীঠস্থানে পরিণত করে বিশ্বপ্রাঙ্গণে প্রতিষ্ঠা দিয়ে গেলেন, তাঁদের কাছে বাঙালির তো ঋণের শেষ নেই। বাংলা ও বাঙালির সারা শরীরে ২১ ফেব্রুয়ারি রোদ্দুরের মতো মাখামাখি হোক, বাঙালি একুশের বর্ষণে স্নাত হোক, শৈত্য শিথিলতায় হারিয়ে যাওয়া উত্তাপকে বাঙালি খুঁজে পাক একুশের মধ্যে। বাঙালির রক্তের বর্ণ একুশের চেতনায় আরও গাঢ় হোক।