কেন্দ্রের ‘বঞ্চনা’র বিরুদ্ধে রেড রোডে তৃণমূলের ৩০ ঘণ্টার ধরনা বৃহস্পতিবার শেষ হল বিকাল ৬টা নাগাদ। ধরনা কেন্দ্রের ‘বঞ্চনা’র বিরুদ্ধে হলেও উঠে এসেছে নানা বিষয়।
সেই বিষয় তালিকায় যেমন সিপিএম জামানার নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগ ছিল, তেমনি উঠে এসেছে ডিএ আন্দোলন প্রসঙ্গও। তেমননি উঠে এসেছে আদালতের রায় প্রসঙ্গও।
ধরনা মঞ্চ থেকে তৃণমূল নেত্রী ‘দিল্লি চলো’র ডাক দিয়েছেন। সাংসদপদ খারিজ নিয়ে রাহুল গান্ধীর পাশে দাঁড়িয়েছেন।
দু’দিনের এই ধরনায় প্রথম দিন ভিড় ছিল দলের রাজনৈতিক নেতাদের। দ্বিতীয় দিন রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি ভিড় ছিল দলের গ্ল্যামার জগতের নেতাদের।
তৃণমূলে যোগ দিলেন তরুণ কুমারের নাতি
বৃহস্পতিবার ধরনা মঞ্চে এসে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন অভিনেতা তরুণকুমারের নাতি সৌরভ চট্টোপাধ্যায়। সৌরভ নিজেও একজন অভিনেতা। মঞ্চে উঠে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রণাম করেন সৌরভ।
সৌরভ তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পর মমতা বলেন,”ওঁর পরিবারের সঙ্গে আমার অনেক দিনের পরিচয়। তরুণ কুমার আমার বাবার বন্ধু ছিলেন। উত্তম কুমারের পরিবারের সঙ্গে আমাদের অনেক দিনের সম্পর্ক। এই পরিবার বাংলার সম্মানীয় পরিবার। উত্তম কুমারের মরদেহ রবীন্দ্রসদনে রাখতে দেওয়া হয়নি। এগুলি মানবিকতা নয়, সংস্কৃতি নয়। আমরা সম্পর্কগুলি বজায় রাখি। এগুলিই আমাদের সম্পদ।”
সৌরভ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘ওনাকে ধন্যবাদ জানানোর দৃষ্টতা আমার নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে বাংলাকে দেখেছেন, যেভাবে বাংলার কথা ভেবেছেন, যা অন্য কারও পক্ষে সম্ভব নয়।’
‘আটকালে ট্রেন ভাড়া করে দিল্লি যাব’
বৃহস্পতিবার ধরনা মঞ্চ থেকে ‘দিল্লি চলো’র ডাক দেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রথম দিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাসভবনে ধরনায় বসার হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। বৃহস্পতিবার মমতা বলেন,’আরও এক দফা হোক চলো, দিল্লি চলো। নেতাজি, গান্ধীজি, অম্বেদকর, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের ছবি হাতে নিয়ে আমরাও দিল্লি যেতে পারি।’
ট্রেন আটকানো হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন,”কী করে আটকাবেন? ট্রেন দেবেন না? নিজেরা ট্রেন ভাড়া করে যাব।”
বাম আমলের দুর্নীতির অভিযোগ
ধরনার প্রথম দিন বাম আমলে দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি ধরনা মঞ্চ থেকে বলেন,’বাম আমলে সব ফাইল পুড়িয়ে ফেলা হয়েছেন নয়তো চুরি করেছে।’ তাঁর অভিযোগের আঙুল ছিল বামেদের সরকারি কর্মচারী সংগঠন কো-অর্ডিনেশন কমিটির দিকে।
বাম আমলে নিয়োগে দুর্নীতি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী প্রাথমিক, সেকেন্ডারি এবং হাইস্কুলে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ২০০১, ২০০২, ২০০৯ এবং ২০১০ সালের ফাইল সব লোপাট করেছে ওরা।
এর জবাবে সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন, ”আমরা বারবার বলেছি ফাইল, কাগজপত্র সব আছে। তাতে কী রয়েছে খতিয়ে দেখা হোক। আমরা এই কথা বলার পর মুখ্যমন্ত্রী আর ফাইল প্রকাশ নিয়ে কথা বলার জন্য কোনও যুক্তি পাচ্ছেন না। তাই এখন তিনি এসব কথা বলছেন।’’
‘চোর-ডাকাতরা ডিএ মঞ্চে’
বৃহস্পতিবার ধরনা মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী ডিএ-র দাবিতে আন্দোলনরত সরকারি কর্মীদেরও কটাক্ষ করেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ”যাঁরা বাম আমলে চিরকুটে চাকরি পেয়েছিল। সেই চোর ডাকাতগুলি গিয়ে মঞ্চে বসে আছে।’’
এর প্রতিবাদে, আগামী ৬ তারিখ সরকারি কর্মচারীদের সংগঠন যৌথ মঞ্চ ২৪ ঘণ্টার কর্মবিরতি পালন করবে। ১০ তারিখ ও ১১ তারিখ তাঁদের দিল্লিতে যন্তরমন্তরে ধরনা কর্মসূচি আছে। ১০ তারিখের পর কালীঘাট থেকে হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট, ক্যামাক স্ট্রিট হয়ে একটি মিছিল শহিদ মিনারে আসবে। আগামিদিনে ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘটও ডাকা হবে বলে জানিয়েছেন আন্দোলনকারীরা
আরও পড়ুন
রেড রোডে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধরনার দ্বিতীয় দিন
রাজ্য জুড়ে ১২ হাজার কিলোমিটার রাস্তা, সিঙ্গুর থেকে প্রকল্পের উদ্বোধন
পেনশন প্রসঙ্গ
বাম আমলের নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে বলতে গিয়ে তৃণমূল নেত্রী সরকারি কর্মীদের পেনশন প্রসঙ্গে তোলেন। তিনি বলেন, ‘খুলব খাতাটা? পেনশনটা নিয়ে তাহলে একটু নড়াচড়া করি? কারও ৫৫,০০০ (টাকা), কারও ৬০,০০০। এক তারিখে পেনশন পায়। মাইনে তো পায়।’ তাঁর আরও সংযোজন, ‘কী বন্ধ করব পেনশন? ঠিক আছে। সাধারণ মানুষ দাবি করছেন, আমরা দেখে নেব পরে। সব কর্মচারীর নয়।’
প্রতিক্রিয়ায় সুজন চক্রবর্তী বলেন,”আমার স্ত্রী ৫৫ হাজার টাকা পেনশন পান না। মুখ্যমন্ত্রী শিক্ষামন্ত্রীকে ১৯৯০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সমস্ত নিয়োগ নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে বলেছেন। আমরা চাই অবিলম্বে সেই শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হোক।”
‘কলকাতাকে লন্ডনের থেকেও ভালো করেছি’
রেড রোডের ধর্না থেকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন ‘বলেছিলাম কলকাতাকে লন্ডন করব, তার থেকেও ভালো করেছি। লন্ডনে একটা হাইড পার্ক ও কয়েকটি চিপসের দোকান রয়েছে। আমি নিজে হেঁটে দেখে এসেছি। আর আমাদের ইকো ট্যুরিজম পার্কটি গিয়ে দেখে আসুন।’
‘রাজ্যে ৬৩টি প্রকল্প বন্ধ’
ধরনায় দু’দিন ধর কেন্দ্রে বঞ্চনার বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘রাজ্য থেকে টাকা জিএসটির-র মাধ্যমে কেন্দ্র তুলে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ রাজ্যের প্রাপ্য দিচ্ছে না। আমি নিজে তিনবার প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে দেখা করে জানিয়েছি। আমাদের সাংসদরা প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন।’
তাঁর অভিযোগ,’এই রাজ্যে ৬৩টি প্রকল্প বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বাংলা ১০০ দিনের কাজে পাঁচবার প্রথম হওয়া সত্ত্বেও সব টাকা বন্ধ। মানুষকে কাজ করিয়ে নিয়েও ৭ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়নি।’
অভিযোগ তোলেন গ্রাম সড়ক যোজনা নিয়েও। তিনি বলেন, ‘গ্রাম সড়ক যোজনার চারবার প্রথম হওয়া সত্ত্বেও টাকা বন্ধ। তবে তার জন্য বাংলা বসে নেই। আমরা নিজেদের টাকায় রাস্তাশ্রী প্রকল্প শুরু করেছি। বাংলা পারে। দেড় বছরে ১৬০টি কেন্দ্রীয় দল এসেও কিছু পায়নি। ‘
‘জোট বাঁধলে সবাইকে নিয়ে বাঁধব’
বৃহস্পতিবার ধরনা মঞ্চে দিল্লি যাওয়ার ডাক দিয়ে মমতা বলেন. ‘আমি একা জোট বাঁধতে পারি না। জোট বাঁধলে সবাইকে নিয়ে বাঁধব। টাকা, কেন্দ্রীয় এজেন্সি নিয়ে আমাকে ভয় দেখাতে পারবেন না। ২০২৪ এর সরকার বদলে গেলে, এখন যা যা করছেন তার পাল্টা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি এর আগে অটলবিহারি বাজপেয়ীকে দেখেছি, এত ঔদ্ধত্য দেখিনি। কাজ করালে টাকা দেওয়াটা সাংবিধানিক অধিকার।’ নাম না করে শুভেন্দুকে কটাক্ষ করে বলেন,’এখান থেকে চোর, ডাকাত, গদ্দার যাচ্ছে দিল্লিতে। গিয়ে বলছে বাংলায় কিছু দেবেন না৷ বাংলায় অর্থনৈতিক অবরোধ হলে আমরাও রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অবরোধ করতে পারি।’
সব মিলিয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে কেন্দ্রের বঞ্চনার বিরুদ্ধে ধরনা হলেও, আসলে এখান থেকেই লোকসভা ভোটের সলতে পাকানো হয়ে গেল বলেন মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।