শ্রয়ণ সেন
পূর্ব ভারতের ইতিহাস বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাস বলে টানা কুড়ি দিন কখনো তাপপ্রবাহ চলে না। তাই চলতি তাপপ্রবাহেরও একটি মেয়াদ রয়েছে। সেটি বড়োজোর আর এক সপ্তাহ চলবে। এপ্রিলের শেষেই তাপপ্রবাহ শেষ হবে। আর তার পরেই কালবৈশাখীর পথ প্রশস্ত হবে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কালবৈশাখী শুরু হলেও কলকাতা, হাওড়া এবং দক্ষিণ ২৪ পরগণা আদৌ ঝড়বৃষ্টি পাবে? কেন এই প্রশ্নটা উঠছে সেটা ব্যাখ্যা করার আগে আমরা একটি বুঝে নিই যে কালবৈশাখী তৈরি কী ভাবে হয়।
কালবৈশাখী তৈরি হয় ঝাড়খণ্ডের ছোটোনাগপুর মালভুমি অঞ্চলে। টানা কয়েক দিনের তাপপ্রবাহের ফলে ছোটোনাগপুর মালভূমি অঞ্চলে মাটি এখন বেশ তপ্ত। মাটি যত তপ্ত হবে, তত সেখানে একটি নিম্নচাপ বলয় তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। সেই নিম্নচাপ বলয়ের টানে বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয় বাষ্প ভরা দখিনা বাতাস দক্ষিণবঙ্গের ওপর দিয়ে ঝাড়খণ্ডের ওপরে চলে যাবে।
ছোটোনাগপুর মালভূমির মাটি তো এমনিতেই গরম থাকে। সেখানকার গরম হাওয়া এবং বঙ্গোপসাগর থেকে যাওয়া জলীয় বাষ্পের সংমিশ্রণে উল্লম্ব বজ্রগর্ভ মেঘ তৈরি হয়। সেখান থেকেই সৃষ্টি হয় কালবৈশাখীর যা ধীরে ধীরে রাজ্যের পশ্চিমের জেলাগুলি হয়ে কলকাতার দিকে এগিয়ে যায়।
এ বছরও সেই রকমই হবে। মে মাসের শুরু থেকে একের পর এক কালবৈশাখী তৈরি হতে পারে ছোটোনাগপুর অঞ্চলে। যা ঝড়বৃষ্টি নিয়ে এগিয়ে আসবে দক্ষিণবঙ্গে। পশ্চিমের জেলাগুলি অতিক্রম করে তা এসে পৌঁছাবে কলকাতার উপকণ্ঠে।
তার পর কী হবে, কলকাতায় বৃষ্টি হবে তো? নাকি সব মেঘ উড়ে বেরিয়ে যাবে?
ঝড়বৃষ্টির মেঘকে দুর্বল করে দেওয়ার মতো দুটো ব্যাপার রয়েছে কলকাতা এবং তার আশেপাশের অঞ্চলে। সেটা একটু দেখে নিই।
১) গাছপালা নিধন
কলকাতা এবং হাওড়ায় নগরোন্নয়নের জন্য প্রচুর পরিমাণে গাছ কাটা হয়েছে। কংক্রিটের জঙ্গল তৈরি করার জন্য সাফ হয়ে গিয়েছে সবুজ জঙ্গল। কলকাতা আর হাওড়ায় ঝড় ভালোভাবে না আসার পেছনে গাছের উধাও হয়ে যাওয়ার একটা বড়ো ভূমিকা রয়েছে।
কেন? সেটা বুঝতে গেলে আমাদের বুঝতে হবে ‘প্রস্বেদন’ (Transpiration)-এর বিষয়টি। কালবৈশাখীর বজ্রগর্ভ মেঘ জলীয় বাষ্পের ওপরে অনেকটাই নির্ভর করে। এই মেঘকে সংগঠিত করে রাখার জন্য জলীয় বাষ্পের প্রয়োজন হয় ভীষণ ভাবে।
কিন্তু কলকাতা ও হাওড়ায় গাছপালা কম থাকায় প্রস্বেদন হয় না। ফলে ঝড়বৃষ্টির মেঘ সঠিক ভাবে জলীয় বাষ্প পায় না। তাদের শহুরে তাপ দ্বীপের শুকনো বাতাসের সম্মুখীন হতে হয়। ফলে ধীরে ধীরে ভেঙে যেতে থাকে এই মেঘপুঞ্জ। ফলে জেলাগুলিতে যে দাপটের সঙ্গে ঝড়বৃষ্টি হয়, তার সিকিভাগও কলকাতা পায় না।
২) দূষণ বলয়
শুধু গাছের অভাব নয়, কলকাতা এবং হাওড়ার ‘দূষণ বলয়’-ও একটা বড়ো কারণ। এটা নিয়ে আগে একটা ব্যাখ্যা করেছি, আবার করছি।
আমরা সবাই জানি যে শহর কলকাতার দূষণ এখন মাত্রাছাড়া। এর ফলে শহরের বায়ুমণ্ডলে দূষিত বাতাসের একটা আস্তরণ তৈরি হয়ে যায়। এটাকে বলা যেতে পারে ‘দূষণ বলয়।’
বর্ষায় যখন কলকাতায় ঘনঘন বৃষ্টি হয় তখন এই দূষিত বায়ুর আস্তরণটি টিকতে পারে না, সহজেই ভেঙে যায়। কিন্তু গরমে যখনই বেশ কয়েক দিন বৃষ্টি হয় না, তখনই দূষিত বায়ুর আস্তরণটি ক্রমে শক্তিশালী হয়। সেই কারণে বজ্রগর্ভ মেঘ কলকাতায় প্রবেশের আগেই শুকনো বাতাসের সম্মুখীন হয়ে দুর্বল হতে শুরু করে।
কলকাতার পাশেই অবস্থিত দক্ষিণ ২৪ পরগণা। গরমের ঝড়বৃষ্টির জন্য তাকে অনেকাংশেই কলকাতার দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। কিন্তু কলকাতায় যদি ঝড়বৃষ্টির মেঘ দুর্বল হয়ে যায় তা হলে সেটা দক্ষিণ ২৪ পরগণায় কী ভাবে পৌঁছাবে, সেটাই এখন বড়ো প্রশ্ন।
ফলে গত কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে দক্ষিণবঙ্গের অন্যান্য জেলায় গরমে যে পরিমাণ ঝড়বৃষ্টি হয়, তার থেকে অনেকটাই কম হয় কলকাতা, হাওড়া এবং দক্ষিণ ২৪ পরগণায়। আশংকা, এই গরমেও সেই ধারা বজায় থাকবে।
আরও পড়ুন