Homeখেলাধুলোফুটবলতুলসীদাস বলরামের ছিল বৈচিত্র্য, বহুমুখিতা আর উদ্ভাবনী ক্ষমতা

তুলসীদাস বলরামের ছিল বৈচিত্র্য, বহুমুখিতা আর উদ্ভাবনী ক্ষমতা

প্রকাশিত

Arunava-Gupta

অরুণাভ গুপ্ত

কিংবদন্তি ফুটবলার তুলসীদাস বলরাম। যে কেউ চ্যালেঞ্জ করলে করবেন, কিন্তু ঘটনা হল আমি দিনের পর দিন খেলা দেখেছি বলেই বলছি, বলরাম নি:সন্দেহে ভারতের সর্বকালের সেরা ফরোয়ার্ড। ১৯৫৬-৬২ বলরামের ‘গোল্ডেন টাইম’, খ্যাতির শীর্ষে বিচরণ করছেন এবং তখন তাঁকে একবাক্যে সকলে বলতেন – বলরাম এশিয়ার সেরার সেরা।

৪ অক্টোবর ১৯৩৭, সেকেন্দরাবাদের ছোট্ট এক‌টা গ্রামে জন্মালেন বলরাম। বাড়ির কাছের মাঠে ফুটবল কসরত। বাবা চাইতেন না অত ছোটো বয়সে ফুটবল খেলুক, কিন্তু বলরাম এ কান দিয়ে শুনে ও কান দিয়ে বের করে দিতেন। খুবই সাদামাটা পরিবারে জন্ম বলে, বলরাম কঠোর অনুশীলনের পর কত দিন অভুক্ত অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েছেন। অনেকের অভিমত – বলরাম যদি পেট ভরে দু’বেলা পুষ্টিকর খাবার খেতে পারতেন, বাজি রেখে বলা যায়, তিনি পার্ক জিংসাং, শিনজি কাগাওয়া, হিদেতোশি নাকাতা প্রমুখের মতন এশিয়ার দিকপাল ফুটবলার হতে পারতেন।

কথায় বলে, জহুরি জহর চেনে। তেমনই জানেমানে কোচ এস এ রহিমের চোখে ধরা পড়লেন বলরাম। স্থানীয় প্রতিযোগিতার আসরে ওঁর খেলা দেখেই রহিমস্যর বুঝে নিলেন, এ ছেলের কাঠামোয় বারুদ মজুত আছে। আর দেরি না করে তিনি ওই আঠারোর তরুণকে সন্তোষ ট্রফির ট্রায়ালে আসতে বললেন। মন আনন্দে লাফালেও পরমুহূর্তে মুষড়ে পড়লেন এই ভেবে, যাবেন কী ভাবে? সেকেন্দরাবাদ থেকে হায়দরাবাদ রোজ যাওয়ার মতো সামর্থ্য যে নেই ওঁর। রহিমস্যর বিচক্ষণ মানুষ, তাই ওঁর অসুবিধা বুঝতে সময় লাগেনি। ওঁকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি প্রতি দিন এক টাকা পঁচিশ পয়সা বলরামের হাতে গুঁজে দিতেন। এই ভাবেই ভারতীয় ফুটবলে কিংবদন্তির জন্ম হল।

বলের উপর বলরামের আধিপত্য অসাধারণ। যেন যা চাইতেন, বল তাই সুবোধ বালকের মতন মানত। এতটাই ফুটবল বশ মানত তাঁর পায়ে। আর গতিতে তো চিতার সমতুল। প্রতিপক্ষের ফুটবলারদের কাছে টেনে নিয়ে এসে, নিমেষে তাঁদের ধোঁকা দিয়ে পায়ের নিখুঁত টোকায় বল বাড়াতেন সতীর্থ ফুটবলারদের উদ্দেশে, পাস তো নয়, একেবারে ঠিকানা লেখা। খুব খারাপ পরিস্থিতিতে গোল করার একটা অদ্ভুত দক্ষতা ছিল বলরামের। ৪ ডিসেম্বর ১৯৫৬, মেলবোর্ন অলিম্পিক্স সেমিফাইনাল ম্যাচে ভারতের জার্সি গায়ে প্রথম বার মাঠে নামার সুযোগ পেলেন বলরাম। প্রতিপক্ষ যুগোস্লাভিয়া। এর পর এক টানা ছ’ বছর তাঁকে বাদ দিয়ে ভারতীয় টিম তৈরি করার কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবেননি। তিনি ছিলেন ফার্স্ট চয়েস।

১৯৬০ রোম অলিম্পিয়াডে, হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে খেলায় বলরামের ভূমিকা আন্তর্জাতিক আসরে ছিল ছবির মতো। হাঙ্গেরি তখন ইংল্যান্ডের মতো বাঘা টিমকে হারাচ্ছে। ইংল্যান্ডের টিমে তখন খেলছেন ববি ম্যুর, ববি চার্লটন, জিমি গ্রিভসের মতো দিকপাল ফুটবলারেরা। এরই মধ্যে ১৯৬০ প্রত্যক্ষ করল হাঙ্গেরির রক্ষণভাগকে ফালাফালা করে দিলেন ভারতের এক ফরোয়ার্ড, নাম তুলসীদাস বলরাম। যেমন বল কন্ট্রোল, তেমন অবিশ্বাস্য গতি। চুনী গোস্বামী মাপা পাস বাড়াতেই বলরাম পায়ের টোকায় বল জালে জড়িয়ে দিলেন।

১৯৫৮ এবং ১৯৬২, দুই এশিয়ান গেমসে বলরাম ছিলেন শ্রেষ্ঠ। ১৯৫৯ মারডেকা আসরে ভারতের স্থান ছিল অপরাজেয় রানার্স-আপ এবং সেখানেও বলরাম তাঁর মুনশিয়ানার প্রমাণ রেখেছেন। ১৯৬২, থাইল্যান্ড এবং জাপানের বিরুদ্ধে বলরামের গোলে ভারত জয় পায়। আবার ফিরি ১৯৫৮-য়, কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের মুখোমুখি হংকং। অতিরিক্ত সময় অবধি গড়াল খেলা, ফলাফল ২-২। বলরাম, ওই যে আগেই উল্লেখ করেছি, ক্রাইসিস ম্যান, চূড়ান্ত পরিস্থিতিতে জ্বলে ওঠেন। সতীর্থদের দিয়ে গোল যেমন করালেন, তেমনই নিজেও গোল করলেন। ফাইনাল বাঁশি যখন বাজল, স্কোরবোর্ডে জ্বলজ্বল করছে, ভারত ৫-২ ব্যবধানে জয়ী। প্রসঙ্গত বলি, আহত অবস্থায় পট্টি বেঁধে শেষ অবধি খেলে গিয়েছেন বলরাম। মাঠ ছাড়ার বান্দা নন। চুনী ছিলেন ড্রিবল মাস্টার, চিত্তাকর্ষক ফুটবলে ওঁর জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু বলরামের ছিল বৈচিত্র্য ও বহুমুখিতা এবং প্রয়োজনীয় মুহূর্তে উদ্ভাবনী ক্ষমতা।

বলরামের ক্লাব ফুটবল শুরু হয় সিটি কলেজ ওল্ড বয়েজ ক্লাবে। ১৯৫৫ হায়দরাবাদে, তার পর সোজা ১৯৫৭ ইস্ট‌বেঙ্গল ক্লাব। পাঁচ বছর দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের নয়নের মণি ছিলেন বলরাম। তাঁর ফ্যানরা এতটাই ভালবাসতেন যে, তিনি যখন জাতীয় ক্যাম্পে যেতেন, তখন তাঁর সঙ্গী হয়ে কিছু ফ্যান যেতেন, উদ্দেশ্য একটাই তাঁদের প্রিয় ফুটবলারের দেখভাল করা। কী রকম? জামাকাপড় কাচাকাচি করা থেকে তাঁর টুকিটাকি কাজগুলি সেরে রাখা। ভালোবাসা কতটা আন্তরিক হলে এমন হয়! তিনি ইস্টবেঙ্গলের হয়ে প্রচুর ট্রফি জিতেছেন এবং ক্লাবের পক্ষে ১০৪টি গোল করেছেন। ১৯৫৯, বলরাম ছিলেন দেশের সর্বোচ্চ গোলদাতা, গোল সংখ্যা ছিল ৩৯। ১৯৬১ কলকাতা লিগে ২৩টি গোল করে ‘গোল্ডেন বুট’ পাওয়ার দুর্লভ সম্মান অর্জন করেন বলরাম। ১৯৬১-তে ইস্টবেঙ্গলের অধিনায়ক হয়ে তিনি লিগ জয় করেন।

ফুটবল দিকপালদের অকুণ্ঠ প্রশংসা পেয়েছেন বলরাম। চুনী গোস্বামী সোজাসুজি বলেছেন, ‘বলরামের শ্যুটিং এবং বল আয়ত্তে রাখা এই দুই ক্ষেত্রে দক্ষতা ছিল অপরিসীম, যা শিল্পের পর্যায়ে ছিল’। অরুণ ঘোষ বলেন, ‘বলরামের মাথার পিছনেও দু’টো চোখ ছিল। যা সমান তালে কাজ করত’। আর জার্নেল সিং অম্লানবদনে স্বীকার করেছেন,’এমন মারাত্মক ফরোয়ার্ড দু’টি দেখিনি। আমার বিপক্ষের সেরা ফরোয়ার্ড, যাঁকে কোনো দিন আমার হার্ড ট্যাকলসের মুখোমুখি হতে দেখলাম না’। পিকে ব্যানার্জির অভিমত, ‘বলরাম ছিলেন অসম্ভব পরিশ্রমী ফুটবলার, সব সময় খেলায় নতুনত্ব উপহার দিয়েছেন। বাঁকানো অর্থাৎ বাঁক খাওয়া শট মারায় তাঁর বিকল্প ছিল না। এ ক্ষেত্রে বলরামের দক্ষতা ছিল শিল্প পর্যায়ে। বর্তমান সময়ের ফুটবলার হলে বলরাম অর্থ প্রাচুর্যে ভাসতেন।’…

আমি সত্যিই ভাগ্যবান যে, এমন ফুটবলারের খেলা দেখতে পেয়েছি। তুলসীদাস বলরাম জাতের ফুটবলাররা অমরত্ব নিয়েই জন্মান। যাঁদের জন্য ফুটবল তখনও বেঁচেছে, এখনও বেঁচে রয়েছে। পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট মেলবন্ধনে থাক। নইলে বলরামরা জীবন্ত থাকবেন কী করে!

লেখক: প্রবীণ ক্রীড়া সাংবাদিক

আরও পড়ুন: সোনালী ত্রয়ীর শেষ সদস্যেরও বিদায়, তুলসীদাস বলরাম প্রয়াত

সাম্প্রতিকতম

গরম নিয়ে আতঙ্ক ছড়াবেন না, আতঙ্কিত হবেন না

শ্রয়ণ সেন আতঙ্ক! আতঙ্ক! আতঙ্ক! সমাজমাধ্যমের পাতা ওলটালেই গরম নিয়ে চূড়ান্ত আতঙ্কজনক খবর! মানুষ গরম অনুভব...

প্রথম দফায়  গডকরী, রিজিজু-সহ মোদী সরকারের ৮ মন্ত্রী, বিজেপির ২ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লড়ছেন ভোটে

লোকসভার পাশাপাশি   অরুণাচল প্রদেশের ৬০ এবং সিকিমের ৩২টি বিধানসভা আসনেও ভোট হবে শুক্রবার।

লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফায় আজ ১০২টি কেন্দ্রে ভোট

খবর অনলাইন ডেস্ক: আজ শুক্রবার শুরু হচ্ছে ভারতের অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন। দেশ জুড়ে প্রায়...

আগামী কয়েক দিন গরম আরও বাড়তে পারে, কিন্তু গরম পড়াও দরকার

শ্রয়ণ সেন যতই হাহাকার করুন না কেন, গরমকালে গরমই পড়া দরকার। এ বছর মার্চ মাস...

আরও পড়ুন

আইএসএল প্লে-অফ পর্যায়ের খেলা শুরু ১৯ এপ্রিল, দেখে নিন কোথায় কোন ম্যাচ

খবর অনলাইন ডেস্ক: ২০২৩-২৪-এর আইএসএল যাত্রা এখনও শেষ হয়নি লিগে প্রথম স্থানাধিকারী ছ’টি দলের।...

বাংলার নববর্ষের সঙ্গে রয়েছে পুণ্যাহের যোগ

মুর্শিদকুলি খা পয়লা বৈশাখের সময় রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করেন। এই সময় ধান উঠত খামারে। আর তখনই রাজস্ব আদায়ের দিনটিকে বেছে নেওয়া হয়। সেটাই পুণ্যাহ উৎসব।

কমবয়সিদের খেলার মাঠমুখো করছে আমতার সোনামুই গ্রামের ফুটবল প্রশিক্ষণ শিবির

নিজস্ব প্রতিনিধি: বর্তমান সময়ের কমবয়সিদের এই সমস্যা নিয়ে আমরা অনেকেই চিন্তাগ্রস্ত। এ নিয়ে উদ্বেগও...