প্রভাত ঘোষ
শীতের গড়িয়ে যাওয়া বিকেল। ঘড়ির কাঁটায় ঠিক সোয়া তিনটে। শুরু হল গার্ডেনরিচ ফুটবল কোচিং সেন্টারের অভিনব কর্মসূচি। ষাট ও ষাটোর্ধ্ব পুরুষ ও মহিলাদের সারা বাংলা হাঁটা প্রতিযোগিতা। ষষ্ঠ বার্ষিকী উৎসবের আনন্দ-দামামা বেজে উঠল পিয়ালি সিংহ, ভোলা তন্ময় এবং উদয়শংকর রায়ের মশালদৌড় দিয়ে। বর্ণাঢ্য এই সূচিতে এর পরেই ছিল জাতীয় পতাকা নিয়ে কচিকাঁচা ফুটবলারদের রঙিন শোভাযাত্রা। ব্যান্ডবাদ্য-সহ অভিভাবকদের মিছিল। সঙ্গে ছিল স্বনামধন্য সরোজ বিশ্বাস ও পরেশ শর্মার ফুটবল জাগলিং। পথের দু’ ধারে জনসমুদ্রের ঢেউ।
ঠিক সাড়ে ৩টেয় ১৫ নম্বর বোরোর চেয়ারম্যান রণজিৎ শীল সবুজ পতাকা নাড়িয়ে শুরু করলেন বয়স্ক পুরুষ ও মহিলাদের হাঁটা প্রতিযোগিতা। প্রায় দুশোজন বয়স্ক পুরুষ ও মহিলা এই প্রতিযোগিতায় যোগ দেন। ষাটোর্ধ্ব তরতাজা যুবক-যুবতীরা প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বাঁচার আনন্দে শুরু করলেন পদচারণার রামনগর মোড় থেকে। তাঁরা এগিয়ে চললেন উদ্দীপনার ঢেউ তুলে। পথের দু’ ধারে তখন অগণিত মানুষ করতালিতে মুখর। চমকপ্রদ এই পথ চলায় উৎসাহ দিতে কেউ দিলেন জলের বোতল, কেউবা উল্লাস-ধ্বনি দিয়ে উৎসাহ জোগালেন।
মশালদৌড়ের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা।
প্রায় দু’ কিলোমিটার পথ অত্যুৎসাহে পার করে জনতার হর্ষধ্বনির মধ্যে প্রতিযোগীরা এসে জড়ো হলেন কোচিং সেন্টারের ‘খেয়ালি খেলাঘর’ মাঠে। স্বেচ্ছাসেবকরা তখন প্রতিযোগীদের বিশ্রাম দিতে ব্যাস্ত। তাঁদের নানা সেবায় নিয়োজিত হলেন স্বেচ্ছাসেবকরা।
এর পর শুরু হল ময়দান-অনুষ্ঠান। ইতিমধ্যে সভাপতি দিলীপ সেন ক্লাবের পতাকা তুলে অনুষ্ঠানের সূচনা করেন। শিশু-শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবক, প্রতিযোগী, কোচ এবং ক্লাব-সদস্য-সহ উপস্থিত জনতার করতালিতে মুখর হল প্রাঙ্গণ। অতি সংক্ষিপ্ত ভাষণে দিলীপবাবু সমগ্র কর্মসূচির উচ্চ সাফল্য কামনা করলেন। নিদারুণ অসুস্থতার জন্য তিনি অল্পক্ষণ থেকে সব প্রতিযোগী ও সংগঠকের প্রভূত প্রশংসা করে অভিনন্দন জানিয়ে বিদায় নেন।
সরোজ বিশ্বাসের ফুটবল জাগলিং।
শুধু কলকাতা ময়দান নয়, দুই বড়ো ক্লাব মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল এবং ভারত-কাঁপানো দাপুটে ফুটবলার কবীর বসু, সুবীর সরকার এবং মনোজিৎ দাস প্রধান অতিথি হিসাবে মূল মঞ্চ আলো করে উপস্থিত হলেন। ১৫ নম্বর বোরো চেয়ারম্যান রণজিৎ শীল, কাউন্সিলর শেখ মুস্তাক আহমেদ প্রমুখ মঞ্চে এলেন। এবং সংহিতা পাল ঘোষের মধুর কণ্ঠে জাতীয় সংগীত শুরু হলে সমবেত দর্শক-জনতা দাঁড়িয়ে উঠে গলা মেলালেন শ্রদ্ধার সঙ্গে। প্রথাগত ভাবে উত্তরীয়, ফুলের তোড়া ও স্মারক দিয়ে অতিথিদের স্বাগত জানানো হল।
প্রয়াত ক্লাব সদস্যদের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করেন অতিথিবৃন্দ। শীত-সন্ধ্যায় অতিথিরা সকলেই সংক্ষিপ্ত ভাষণে তাঁদের মুগ্ধতা প্রকাশ করেন। বয়স্কদের সুস্থ, আনন্দময় জীবন কাটানোর এমন অভিনব পন্থা উদ্ভাবনে গার্ডেনরিচ ফুটবল কোচিং সেন্টারের সোনালি উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করেন তাঁরা।
মঞ্চে ছিলেন এককালের দাপুটে ফুটবলার কবীর বসু, সুবীর সরকার এবং মনোজিৎ দাস।
এই ক্লাব শুধুমাত্র খেলোয়াড় তৈরিতে বিগত ২৩ বছর ধরে নিবিষ্ট আছে তা নয়, ‘আমফান’ বা ‘ইয়াস’-এর মতো যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে সুদূর সুন্দরবনে গিয়ে আর্তজনের সেবার কাজেও ঝাঁপিয়ে পড়ে। একই সঙ্গে স্বনামধন্য ফুটবলার অর্ণব মণ্ডলের খেলা শেখার পাঠশালায় প্রতিদিন সযত্নে নিয়োজিত থাকে এই ক্লাব। বিগত বছরগুলোর মতো আগামী বহু বছর এই ক্লাবের সদস্যদের মহতী প্রয়াস উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠুক, সকলে এই কামনা করেন।
এর পর পুরস্কার প্রদানের পালা। হাঁটা প্রতিযোগিতায় যোগদানকারী বয়স্ক পুরুষদের মধ্য থেকে প্রথম দশজন এবং মহিলাদের মধ্য থেকে প্রথম দশজন, মোট কুড়িজনকে বিশেষ স্মারক, তোয়ালে, ফুল ইত্যাদি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। পুরুষ বিভাগে রবীন মণ্ডল, সঞ্চিত পাল, চিত্তরঞ্জন মণ্ডল, বীরেন্দ্রনাথ সরকার, নির্মলকুমার মণ্ডল, শ্যামলকৃষ্ণ ঘোষ, নিমাই অধিকারী, মোহম্মদ হাফিজ, গণেশ মণ্ডল প্রমুখ পুরস্কার পান। মহিলা বিভাগে যথাক্রমে মিনতি সরকার, নিলীমা পাল, নমিতা চক্রবর্তী, শিপ্রা দাস, রেখা রায়, সন্ধ্যা দে মালাকার প্রমুখ পুরস্কৃত হন।
পুরস্কৃত করা হল প্রতিযোগীদের।
সবচেয়ে বয়স্ক পুরুষ ৮৮ বছরের গোবর্ধনচন্দ্র ঘোষকে এবং সবচেয়ে বয়স্ক মহিলা ৮৬ বছরের গৌরী সিংহকে স্মারক শিল্ড প্রদান করেন ক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক সন্দীপ পাল এবং সংহিতা পাল ঘোষ। উল্লেখ্য, যাঁরা তাঁদের পিতা বা মাতার নামে উৎসর্গ করে এই সব স্মারক দিয়েছেন, তাঁরাই এই সমস্ত পুরস্কার প্রতিযোগীদের হাতে তুলে দেন। সঙ্গে অতিথিবৃন্দও পুরস্কারে প্রতিযোগীদের সম্মান জানান। সমস্ত প্রতিযোগীই বিশেষ পুরস্কারে সম্মানিত হন।
একসাথে দুশো মানুষের পদচারণা, বয়স্কদের প্রাণ জুড়ে আনন্দের উন্মাদনা ও সুচারু পরিবেশনায় সমগ্র অনুষ্ঠানটি অত্যন্ত বর্ণময় ও মনোজ্ঞ হয়ে ওঠে।