Homeপ্রবন্ধবাংলার মায়াকোভস্কি কাজী নজরুল ইসলাম

বাংলার মায়াকোভস্কি কাজী নজরুল ইসলাম

প্রকাশিত

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

একজনের এই পৃথিবীর আলো দেখা ১৮৯৩ সালে, আর একজনের ১৮৯৯ সালে। প্রথমজনের নাম ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি আর দ্বিতীয়জনের নাম কাজী নজরুল ইসলাম। প্রথমজনের বাবা কোসাক, মা জর্জিয়ান। আর দ্বিতীয়জনের মা এবং বাবা দুজনেই এই বাংলার অতি সাধারণ দরিদ্র আটপৌরে বাঙালি। কিন্তু মিল রয়েছে বিপ্লবের গানে, বিপ্লবের কবিতায়, নতুন আঙ্গিকের গল্পে।

তখন ভারতবর্ষ পরাধীন। বেঁকে যাওয়া শিরদাঁড়া নিয়ে “সব কিছু মুখ বুজে মেনে নেওয়ার” যে গোলামিয়ানার মানসিকতা, সেই দাসত্বের মানসিকতায় নিমগ্ন ছিল এ দেশের মানুষ ১৯২৫ সালের ২০/২৫ বছর আগে। তখন তাদের মনের মধ্যে জাতীয়তাবাদের জন্ম দিয়েছেন স্বামী বিবেকানন্দ।

সেই জাগৃতির পথ অনুসরণ করেই এই বাংলার মাটিতে এসে দাঁড়ালেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের এক সৈনিক, যিনি এই শস্যশ্যামলা বাংলার মাটি থেকে গিয়েছিলেন সুদূর মধ্য এশিয়ার রণাঙ্গনে। সেখান থেকে নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে, সদ্য রাশিয়ার বিপ্লবের নানান ঘটনায় প্রভাবিত হয়ে জানিয়ে দিলেন তাঁর উপস্থিতি – ‘বল বীর, বল উন্নত মম শির…’-এর মতো এক বিদ্রোহীর বলিষ্ঠ উচ্চারণে। স্থবিরতার জড়িমার ঘোর যেন এক ঘায়ে চমক মেরে কাটিয়ে দিলেন তিনি। তিনি বললেন – “এই শিকল-পরা ছল, মোদের এ শিকল-পরা ছল।/ এই শিকল পরেই শিকল তোদের করব রে বিকল।।”

বিস্মিত রবীন্দ্রনাথ। চিনতে পারলেন তিনি। আহ্বান করলেন ‘ধুমকেতু’ বোলে। দুজনে হলেন কাছাকাছি। সেই সময়ের দেশের স্বাধীনতার কাজে উদ্বুদ্ধ বিপ্লবীরা স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শ বুকে নিয়ে, পথে-প্রান্তর থেকে ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে উঠছেন রবীন্দ্রনাথ, গেয়ে উঠছেন কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে যাচ্ছেন নজরুল। ছড়িয়ে যাচ্ছে নজরুলের বিদ্রোহের গান, বিপ্লবের আবাহনী কবিতা। গল্প, উপন্যাস।

এ দেশের মাটিতে সাম্যবাদের বাতাবরণ সৃষ্টি করতে শুরু করলেন দুই বঙ্গসন্তান –মুজফফর আহমেদ আর কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁদের হাতিয়ার ‘লাঙ্গল’, না কোনো অস্ত্র নয়, তার চেয়েও বহু শক্তিশালী, একটি পত্রিকা।

১৯২৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর। বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে প্রকাশিত হচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষের জন্য পত্রিকা, তাদের নিজস্ব পত্রিকা ‘লাঙ্গল’, যার সম্পাদক হিসাবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করলেন কাজী নজরুল ইসলাম। এই পত্রিকার মাধ্যমে বাঙালি জানল রুশ লেখক ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মাদার’-এর বাংলা অনুবাদ। বলিষ্ট ভাবে সেই কাহিনির ধারাবাহিক অনুবাদ করেছিলেন নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়। কুতুবউদ্দিন আহমেদের লেখা ‘লেনিন ও সোভিয়েত রাশিয়া’ পড়ল পাঠক। ‘লাঙ্গল’-এ লিখলেন রবীন্দ্রনাথ, লিখলেন কাজী নজরুল ইসলাম, লিখলেন মুজফফর আহমেদ প্রমুখ।

জানা যায় যে রাশিয়াতে ১৯২০ সালে ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ তথা লেনিন-এর আদেশেই শুরু হয়েছিল ‘ইনস্টিটিউট অফ ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ’। সেইখানে পরে ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো হত এই ‘লাঙ্গল’ পত্রিকা। শুধু তা-ই নয়, কাজী নজরুল ইসলামের বিভিন্ন সময়ে লেখা কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদিও সেখানে পড়ানো হত। সেইখানেই সেই সব লেখা পড়ে রাশিয়ার মানুষ মেলাতে শুরু করেছিলেন তাঁদের দেশের বিপ্লবী কবি ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কির সাথে এই বাংলায় জন্ম নেওয়া খেটে খাওয়া মানুষের কবি কাজী নজরুল ইসলামকে।

এককথায় বলা যায়, আমাদের বাংলা তথা ভারতবর্ষে জন্ম নিলেন বাংলা সাহিত্যের মায়াকোভস্কি – কাজী নজরুল ইসলাম। মায়াকোভস্কির বিশ্ববিখ্যাত কবিতার নাম ‘শিরদাঁড়ার বাঁশি’ (backbone flute), আর কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন ‘বিষের বাঁশি’ কাব্যগ্রন্থ।

কাজী নজরুলের বিদ্রোহী যুগের প্রায় সমস্ত কবিতায় রয়েছে সাম্যবাদের সুস্পষ্ট প্রভাব এবং সাম্যবাদের প্রভাবের জন্যই তাঁর ভিতরে ঘনীভুত হয়েছে এ দেশের, এই পৃথিবীর দুঃস্থ, বঞ্চিত, অবহেলিত, উপেক্ষিত, অত্যাচারিত মানবতার জন্য তাঁর দরদ।

কাজী নজরুলের কাব্যগ্রন্থগুলি তো রয়েইছে, তাঁর বিপ্লবের বিদ্রোহের গান তো রয়েইছে। তা ছাড়া তাঁর ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত ‘ব্যথার দান’-এর গল্পগুলি, ১৯২২-এ প্রকাশিত ‘বাঁধনহারা’, ১৯৩০-এ প্রকাশিত ‘মৃত্যুক্ষুধা’ এবং ১৯৩১ সালে প্রকাশিত ‘কুহেলিকা’ উপন্যাস ইত্যাদিতে সাম্যবাদের কথা ক্রমশ গাঢ় এবং বলিষ্ঠ সুদৃঢ় অক্ষরে গ্রন্থিত।

কাজী নজরুল ইসলাম যে কোনো দেশের, যে কোনো যুগের মানুষের মুক্তিসংগ্রামের কথাকে, মুক্তি আন্দোলনের স্রোতধারাকে এক করে দিয়েছিলেন।

মায়াকোভস্কি যেমন অশান্ত হয়েই নিজেকে শেষ করে দিয়েছিলেন ১৯৩০ সালে, ঠিক তেমনই এক প্রচণ্ড অশান্তি নিয়ে আমাদের কাজী নজরুল ইসলামের সমস্ত স্নায়ুতন্ত্র নীরব হয়ে গিয়েছিল ১৯৪২ সালে। আর ১৯৭৬ সালে তিনি চলে গেলেন নক্ষত্রের দেশে, শুধু রয়ে গেল তাঁর সৃষ্টি আর রয়ে গেল নয়নের সমুখে তাঁর স্থির নিস্পন্দ ছবিখানি।

আজও তাই মৌনমুখরতায় উচ্চারিত হয় মানুষের অন্তরমহলে – “মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত/ আমি সেইদিন হব শান্ত,/ যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,/ অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভুমে রণিবে না –/ বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত/ আমি সেইদিন হব শান্ত…।”

সাম্যবাদের বিশ্ব-অঙ্গনে এইখানেই একাকার রাশিয়ার মায়াকোভস্কি আর আমাদের বাংলা তথা ভারতবর্ষের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, যিনি একাধারে প্রেমিক, সাধক, মানবপ্রেমে পাগল, স্রষ্টা এবং ‘বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাত্রীর’।

আরও পড়ুন

মৃণাল সেনের ‘কোরাস’ এবং কিছু কথা

আপনার প্রশ্ন, আমাদের উত্তর

সাম্প্রতিকতম

ঋণগ্রস্ত বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলির জন্য ১ লক্ষ কোটির ‘বেলআউট’ প্যাকেজ আনছে কেন্দ্র; শর্ত বেসরকারিকরণ

ঋণে জর্জরিত রাজ্য বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলির জন্য ১ ট্রিলিয়ন রুপিরও বেশি উদ্ধারপ্যাকেজ ঘোষণা করতে চলেছে কেন্দ্র। শর্ত—রাজ্যগুলিকে তাদের বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা বেসরকারি হাতে তুলে দিতে হবে বা শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করতে হবে।

কলকাতায় আত্মপ্রকাশ গোদরেজ হাউসিং ফিন্যান্সের, পূর্ব ভারতে ঋণ পরিষেবায় নতুন দিগন্ত

পূর্ব ভারতে আর্থিক পরিষেবা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে কলকাতায় প্রথম শাখা চালু করল গোদরেজ হাউসিং ফিন্যান্স। ৭.৭৫% সুদে হোম লোন, নারীদের জন্য বিশেষ ‘আরোহী হোম লোন’ অফারসহ গ্রাহককেন্দ্রিক পরিষেবা দেবে সংস্থা।

মোন্থা আপডেট:  কাকিনাড়ায় আছড়ে পড়ল ঘূর্ণিঝড়, দুর্বল হলেও বৃষ্টি ঝড়ে বিপর্যস্ত একাধিক রাজ্য, বাংলায় কতদিন বৃষ্টি?

গত ২৮ অক্টোবর রাতে কাকিনাড়া উপকূলে আছড়ে পড়েছে ঘূর্ণিঝড় মোন্থা। ঘণ্টায় ৯০-১১০ কিমি গতিবেগে উত্তর অন্ধ্রপ্রদেশ উপকূল অতিক্রম করেছে ঘূর্ণিঝড়টি। বর্তমানে দুর্বল হলেও দক্ষিণ ওড়িশা, ছত্তীসগঢ়, ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গে বৃষ্টি ও বিপর্যয়ের আশঙ্কা রইল।

এআইএফএফ সুপার কাপ ২০২৫-২৬: মহেশের জাদু জেতাল ইস্টবেঙ্গলকে, মোহনবাগানকে রুখে দিল ডেম্পো  

ইস্টবেঙ্গল এফসি: ৪ (কেভিন সিবিলে, বিপিন সিং ২, হিরোশি ইবুসুকি) চেন্নাইয়িন এফসি: ও মোহনবাগান সুপার...

আরও পড়ুন

কত দূরের, তবু কত কাছের তিনি – উত্তমকুমার

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায় ১৯২৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর, আহিরীটোলার বাপের বাড়িতে শ্রীমতী চপলা দেবী জননী হলেন। অত্যন্ত...

স্বাধীনতা আন্দোলনের অলিখিত ইতিহাস: ভুলে গিয়েছি অগ্নিস্নাত বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষকে  

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায় মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করেননি। বিধানচন্দ্র রায়কে আশীর্বাদও করেননি। বল্লভভাই পটেলের...

স্বাধীনতা আন্দোলনের অলিখিত ইতিহাস: ‘এবার তবে আসি মা!’

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায় একটা সুবৃহৎ দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস এত পক্ষপাতিত্ব করে লেখা হয়েছে, যার উদাহরণ...