শক্তি চৌধুরী
উপলব্ধির প্রকাশের নামই ভাষা। দিন যায় মাস গড়ায় বয়েস বাড়ে সভ্যতার। বদলে যায় মানুষের উপলব্ধি, তার ভাবনার জগৎ। বদলে যাওয়া মানুষের চাই এমন একটা ভাষা যাতে সে তার নিজের কথা বলতে পারবে। বদলে যাওয়া শিক্ষাব্যবস্থায় ভাষা এখন রাজার দুয়োরানির সন্তান। পাস আমরা অনেক করি, কিন্তু জ্ঞান? বিশেষত ভাষাশিক্ষার পর্যাপ্ত সময় এখন কোথায়। কিন্তু ভাব তো বেঁচে আছে, প্রকাশের ইচ্ছেও রয়েছে বুক ভরা। যে ভাষায় সাধারণ মানুষ যত বেশি সহজ ভাবে, তার নিজের কথা বলতে পারে, সেই ভাষা তত বেশি জীবন্ত। ভাষার স্থান পরস্পর আদানপ্রদানে। ভাষার স্থান লাইব্রেরির নির্জন র্যাক নয়।
এখন প্রশ্ন হছে, আধুনিক সমাজে যোগাযোগের মাধ্যম কী? আজ থেকে মাত্র বছর ২০ আগেও চিঠিপত্র লেখার একটা চল ছিল, গল্প-উপন্যাস পড়ার ও তা নিয়ে চর্চার একটা রেওয়াজ ছিল আমাদের। কিন্তু এখন সময়ের অভাবেই বলুন বা ধৈর্যের খামতিতেই বলুন, মানুষের যোগাযোগের ব্যবস্থা আমুল বদলে গেছে। দ্রুত গতির ই-মেল, চ্যাট, সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইট – সোজা কথায় যন্ত্র নির্ভরতা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১০০%। আর ঠিক এই জায়গাতেই হারিয়ে যেতে বসেছে পৃথিবীর এক বিশাল সংখ্যার আঞ্চলিক ভাষা। ভাষাকে কারিগরি উপযোগী করে তোলা এবং তার সবার গ্রহণযোগ্য সাধারণ (Standard) রূপ তৈরি করা যথেষ্ট কঠিন কাজ। তবুও শহিদ লিপি ১৯৮০-তে বা বিজয় ১৯৯০-এর দশকে যথেষ্ট সুনামের সঙ্গে কাজ করেছিল। তাদের প্রচেষ্টাতে ডিজিটাল দুনিয়া থেকে বাংলা ভাষা হারিয়ে যায়নি।
বাংলা ভাষাকে সাবলীল ভাবে ডিজিটাল মাধ্যমে ব্যবহার করার উদ্যোগ বহু দিনের। মুদ্রণশিল্পে এর সফল প্রয়োগ ঘটলেও অনলাইন নেটওয়ার্কিং-এ কিন্তু বাংলা ভাষা কিছুটা ব্রাত্যই ছিল এত দিন। এর মুল সমস্যা ছিল ফন্ট (font) বা অক্ষর। সোজা কথায় ধরুন, এক জন কম্পিউটারে একটা মেসেজ লিখল কিন্তু অন্য জন সেই মেসেজ পরতে পারবে না যদি না তার কম্পিউটারে ওই নির্দিষ্ট ফন্ট আগে থেকে ইনস্টল করা না থাকে। এ ছাড়াও আলাদা আলাদা সফটওয়্যারে আলাদা আলাদা জটিল বাংলা কি বোর্ড লেআউট ব্যবহার করা সধারণ কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের পক্ষে বেশ কঠিন ছিল। এই ‘ক্রস প্ল্যাটফর্ম’ ব্যবহারযোগ্যতার অসুবিধা দূর করতে মাঠে নামেন ডাক্তারির ছাত্র মেহদি হাসান খান।
২০০৩-এ প্রথম বার মেহেদি হাসান প্রকাশ করেন তার প্রথম বাংলা সফটওয়্যার ‘অভ্র’, যেখানে সাধারণ ইংরাজি কিবোর্ডে ফন্ট নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছাড়াই আমরা বাংলা লিখতে শুরু করলাম। আমাদের কোনো আলাদা লে আউট সমস্যা মনে রাখার বিশেষ প্রয়োজন হল না। সাধারণ ভাবে বলা যায় ইংরিজি হরফে বাংলা লিখলেই চলবে, যেমন আপনি লিখলেন “tumi kemon acho” অভ্র নিজেই সেটিকে পরিবর্তন করে লিখল “তুমি কেমন আছ?”। মেহেদি যে বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন তার নাম ‘ক্রস প্ল্যাটফর্ম, ফোনেটিক, গ্রাফিক্যাল কি-বোর্ড লে আউট’।
অভ্রকে তাদের ভাষা বিভাগের স্ট্যান্ডার্ড সফটওয়্যার হিসাবে স্থান দিয়েছে মাইক্রোসফট উইন্ডোজ, ন্যাক ওএস এক্স এবং লিনাক্সের মতো সংস্থা। এতে তার জনপ্রিয়তা এবং ব্যবহার বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। প্রায় সমস্ত সফটওয়্যার প্ল্যাটফর্ম এই অভ্রকে ‘ডিফল্ট বেঙ্গলি ইনপুট মেথড’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। এতে দেশবিদেশের সাধারণ বাঙালির মধ্যে আবার নিজের ভাষা ব্যবহারের স্বস্তি ফিরে এসেছে।
মেহেদি হাসান তাঁর সমস্ত গবেষণা ও আবিস্কার একেবারে বিনা পারিশ্রমিকে বিশ্বের সকল বাঙালির উদ্দেশে দান করেছেন। বাংলাদেশ সরকার সরকারি সফটওয়্যার হিসাবে তার সফটওয়্যারকে ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা বাঁচিয়ে ভোট, জনগণনার মতো গুরুত্বপূর্ণ নানা সরকারি কাজ করছেন।
২১ ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত দিনে যে শহিদদের রক্ত বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়েছিল, তাঁদেরই সার্থক উত্তরসূরি মেহেদি হাসানকে খবর অনলাইনের স্যালুট রইল।