Homeপ্রবন্ধবাংলা সাহিত্যের অন্যতম মহারথী তারাশঙ্কর ও কিছু কথা

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম মহারথী তারাশঙ্কর ও কিছু কথা

প্রকাশিত

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

তখন কলকাতায় ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব। জ্বরে প্রায় অজ্ঞান হয়ে আছে মেয়ে গঙ্গা। ডাক্তার ডাকা হল, কিন্তু ঘরে তেমন টাকাকড়ি নেই, কী হবে? উপস্থিত ছিলেন শিল্পী যামিনী রায়, তিনিই দিলেন ভিজিটের টাকা। পরের দিন ছুটলেন পাওনা ৭৫ টাকার জন্যে, ‘প্রবাসী’র দফতরে। কিন্তু না, পেলেন না। ১০ দিন পরে আসতে বলা হল। প্রকাশ্য দিবালোকে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ অভুক্ত তারাশঙ্কর, তার পর চোখ ফেটে বেরিয়ে এল কান্না। পকেটে মাত্র আনা তিনেক পয়সা। পেটের জ্বালায় একমুঠো মুড়ি আর ছোলা কিনে খেলেন। এর পরে গেলেন কাত্যায়নী বুক স্টলে, গিরীন্দ্রনাথ সোমের কাছে। তিনি দিলেন ১০০টা টাকা, দিলেন দুটো মিষ্টি আর পিপাসার জল। তারাশঙ্কর আপ্লুত। কান্নায় ভেঙে পড়লেন।

১৯৯৮ সালের ২৩ জুলাই এই বাংলার বীরভূমের লাভপুরে জন্মেছিলেন তারাশঙ্কর। বাবা হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় আর মা প্রভাবতী দেবী। লেখাপড়া লাভপুরে যাদবলাল এইচ ই স্কুলে, পরে বহরমপুর কলেজে, তার পর কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। কিন্তু তখন সময়টা ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্রান্তিকাল। জড়িয়ে পড়লেন আন্দোলনে, রাজনীতিতে। পাশাপাশি ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেল। ইতিমধ্যে বিয়ে করেছেন, স্ত্রী উমাশশী দেবী।

রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় তিনি পেলেন আঘাত। যদিও দেশের জন্য কারাবাসে ছিলেন সিউড়ি জেলে চার মাস। এটা সেটা কাজ করেছেন পেটের দায়ে। কিন্তু লেখালেখি চলছে সেই কিশোরবেলা থেকেই। কিন্তু সাহিত্যিক হিসাবে স্বীকৃতি পেতে পেতে জীবনের প্রথম ৩০টা বছর পেরিয়ে গিয়েছে। ধীরে ধীরে নামডাক হয়েছে, বাড়ি-গাড়ি হয়েছে।   

সেটা ১৯৫৫ সাল, তারাশঙ্করের  তিক্ত অভিজ্ঞতা হল। আচার্য বিনোবা ভাবে এসেছিলেন বাঁকুড়ায়, ভূদান হিসেবে পৈতৃক সম্পত্তির থেকে কিছু অর্থ তারাশঙ্কর দান করেছিলেন। এর পর তিনি শুনলেন যে কংগ্রেস নেতা অতুল্য ঘোষ খোঁচা দিয়ে মন্তব্য করেছেন যে, কংগ্রেসের তহবিলে কিছু না দিয়ে এমন কাজ করার মানে হল নাম কেনার চেষ্টা। তারাশঙ্কর আঘাত পেলেন, ছেড়ে দিলেন কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক।

তারাশঙ্কর মার্ক্সবাদী বুদ্ধিজীবীদের প্রাধান্য থাকা সেই সময়ের ‘অ্যান্টি ফ্যাসিস্ট রাইটার্স অ্যান্ড আর্টিস্টস অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভাপতি হয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য ও বিরূপ কথা বলা হলে, তিনি সেই সংগঠন ত্যাগ করে দিলেন। তারাশঙ্করের প্রাণের মানুষ ছিলেন সুভাষচন্দ্র। গান্ধীকেও তিনি ভালোবাসতেন। কিন্তু অতটা নয়, যেমন সুভাষচন্দ্র বসুকে ভালোবাসতেন। তিনি ভালোবাসতেন আরও একজনকে। তিনি হলেন মহামতি ভি আই লেনিন। কমিউনিস্টদের সঙ্গে মতবিরোধ থাকলেও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় লেনিন সম্পর্কে বলেছিলেন – “রুশ বিপ্লব এবং মহান লেনিনই সকল মানুষের মুক্তির বার্তা ও পন্থাই আমাকে প্রথম জ্ঞাপন করেছিলেন।” লেনিন সম্পর্কে তিনি উচ্চারণ করেছেন ‘পথপ্রদর্শক’, ‘আশ্চর্য মানববন্ধু’ এই শব্দগুলি।

তারাশঙ্কর ছিলেন বাস্তব সমাজের সাহিত্য-চিত্রের জহুরি। রবীন্দ্রনাথের বলা কথা ‘বাস্তবতার’ প্রত্যক্ষ স্রষ্টা হলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর লেখা বিভিন্ন গল্পে, উপন্যাসে থাকা বিভিন্ন চরিত্র বাস্তব জীবন থেকে উঠে এসেছে। না, কোনো চরিত্রই কাল্পনিক নয় আদপেই।

যেমন ‘পদচিহ্ন’-এর গোপীচন্দ্র চরিত্রটি লাভপুরের যাদবলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘পঞ্চগ্রাম’-এর স্বর্ণময়ী বাস্তবের লাভপুরের অন্নপূর্ণা পাল। ‘শুকসারী-কথা’-র সীমা হলেন আসলে লাভপুরের দুর্গা পাল। তারাশঙ্করের গাড়ির চালক বীরভূমের মহুটা গ্রামের করালী মণ্ডল হলেন ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ উপন্যাসের করালী কাহার চরিত্রটি।

আসলে তারাশঙ্করের ছিল মাটির মানুষের সঙ্গে আজীবনের মেলামেশা। তাঁরাই পরে তারাশঙ্করের বিভিন্ন লেখায় চরিত্রায়িত হয়েছেন। ‘পদ্মশ্রী’, ‘পদ্মভূষণ’, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার, রবীন্দ্র পুরস্কার, অ্যাকাডেমি সম্মাননা, জগত্তারিণী পদক, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডক্টরেট পাওয়া সত্ত্বেও বা বিধান পরিষদের সদস্য, রাজ্যসভার সদস্য হওয়া সত্ত্বেও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন বাস্তবের, সমাজের, কালের গণদেবতার আত্মার আত্মীয়। তারাশঙ্করের ‘জলসাঘর’, ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’, ‘গণদেবতা’, ‘সপ্তপদী’, ‘মঞ্জরী অপেরা’, ‘কবি’, ‘আরোগ্য নিকেতন’-সহ ৪০-টিরও বেশি সৃষ্টি চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। বেশ কিছু নাটক মঞ্চে অভিনীত হয়েছে। তবু তিনি ছিলেন মনে মনে এক সাধক। তিনি জীবনের অর্থ সন্ধানে নিলেন দীক্ষা, চাইলেন সন্ন্যাস নিতেও। বাড়ি ছেড়ে দিলেন একবার। তার পর আবার ঈশ্বর অনুভূতি নিয়েই ফিরে এলেন সংসারে। একবার কাজী নজরুল ইসলাম তারাশঙ্করের বাড়িতে এসেছিলেন, সারা দিন ছিলেন আনন্দ করলেন। যাবার সময়ে তিনি জানতে পারলেন যে সে দিনই তারাশঙ্করের শিশুপুত্র মারা গেছে এবং তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তার সৎকার করে ফিরেছেন। সে দিন কাজী নজরুল সব শুনে বলেছিলেন – “ভারতবর্ষের একজন খাঁটি মানুষকে দেখে গেলাম।…ভারতবর্ষকে প্রণাম জানাই তোমার কাছে।” এই ভারতবর্ষের দর্শন, আধ্যাত্মিকতার চেতনাই বারবার ফিরে এসেছে তারাশঙ্করের জীবনে এবং সাহিত্যে।

সে দিন তখন সন্ধ্যা নেমেছে। আজান আর শাঁখের আওয়াজে মুখরিত সন্ধ্যা। প্রবীণ সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় শোনাচ্ছেন মহাভারতের কাহিনি। শুনছেন পরিচালক তপন সিংহ। হঠাৎ একজন বৃদ্ধা এসে প্রণাম করলেন তারাশঙ্করকে… “কে রে? নুসু নাকি রে?” তার পর তপন সিংহকে বললেন, “দেখুন এই হল ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’-র নুসুবালা। তপনবাবু দেখছেন, সামনে সেই বৃদ্ধা আসলে একজন পুরুষমানুষ, বাইরের পোশাকে, ভাবেভঙ্গিতে সে নারী, মনেও সে নারী। তাকে পাশে বসিয়ে নিলেন তারাশঙ্কর। দু’জন দু’জনের কত কালের বন্ধু। তপন সিংহ বিস্মিত তাই দেখে।

ওই সময়ে একদিন তপনবাবু তারাশঙ্করের সাথে গেলেন ময়ুরাক্ষী নদীর ধারে একটি গ্রামে। চারিদিকে লালমাটির বাড়ি। একটি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সাহিত্যিক দিলেন হাঁক। এক ভাঙাচোরা দেহের বুড়ো মানুষ বেরিয়ে এলেন। তার পর দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না, হাউ হাউ করে। কিছুক্ষণ পরে তারাশঙ্কর বন্ধুকে বলে উঠলেন, “শান্ত হ রে, শান্ত হ” – তিনি তারাশঙ্করের সহপাঠী। অকালে পুত্রবিয়োগের শোকে অধীর। তপনবাবুকে বললেন তারাশঙ্কর, “ইনিই ‘আরোগ্য নিকেতন’-এর ডাক্তার-কবিরাজ, চিনতে পারছেন।”

তারাশঙ্কর ছিলেন এমনই। যিনি মহাভারত আর মহাকালের গল্প বলতে বলতে বাংলার সমকালীন যুগের বিগত কালের কথা বলেন, বিনিসুতোর মালায় গেঁথে চলেন এই বাংলার লোকবিশ্বাসের কথা ও কাহিনি।

সেই মাতৃসাধক তারাশঙ্কর (পুত্রলাভের জন্য মা প্রভাবতী দেবী মা তারার কাছে মানত করেছিলেন। তাই নাম রাখেন তারাশঙ্কর) চিরকল্যাণময়ী মায়ের শীতলপাটির অনন্ত শয্যায় চিরনিদ্রায় ঘুমের দেশে চলে গেলেন। দিনটা ছিল ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সাল।

এক কথায় বলা যায়,তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যে বিধাতার আশীর্বাদ। আজ ২৩ জুলাই। তাঁর জন্মের ১২৫ বছর পূর্ণ হল। রেখে গেলাম তারাশঙ্করের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা এবং প্রণাম।

তথ্যসূত্র:

আমার সাহিত্য জীবন – তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

আমার পিতা তারাশঙ্কর – সরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।

মহাকালের কথা – অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দবাজার পত্রিকা।  

আরও পড়ুন:

এক অজানা বিপ্লবী হরিকিষণ তলোয়ার এবং কিছু কথা

সাম্প্রতিকতম

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ২০২৫: উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, সময়, ভেন্যু ও পারফর্মারদের তালিকা প্রকাশ

প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হচ্ছে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ২০২৫। এবারের আয়োজক...

নিউটাউনে কিশোরীকে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার জের, কর্মরত মহিলাদের নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ হাইকোর্টের

নিউটাউনে কিশোরীকে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় ক'দিন আগেই চাঞ্চল্য ছড়ায়। এর পর কর্মরত মহিলাদের...

সকালে উঠে কলা? উপকারিতা জানলে চমকে যাবেন

অ্যাসিড রিফ্লাক্স একটি সাধারণ সমস্যা হলেও এটি দীর্ঘস্থায়ী হলে স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে...

জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণে বাধা কাটাতে কড়া নির্দেশ হাইকোর্টের

রাজ্যের জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের কাজে আর বাধা সহ্য করা হবে না। স্থানীয় জবরদখলকারীদের বিরুদ্ধে...

আরও পড়ুন

মহাকুম্ভে মনালিসার সৌন্দর্যে মুগ্ধ নেটদুনিয়া, অন্ধকারে পারধি সম্প্রদায়ের ইতিহাস ও সংগ্রাম

পারধি শব্দটি এসেছে মারাঠি শব্দ 'পারধ' থেকে, যার অর্থ 'শিকার'। প্রাচীনকালে পারধিরা শিকারি ও বনবাসী হিসেবে পরিচিত ছিল।

বাঘিনি জিনতকে বাগে আনতে হিমসিম বন দফতর, সম্ভাব্য যে কারণে স্থানান্তর করে বাঘেরা

বাঘেদের চলাফেরা এবং আচরণ শুধু তাদের জীবনধারণের অংশ নয়, বরং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ...

পরমাণু অস্ত্রবিরোধী সংগঠন নিহন হিদানক্যো কে শান্তির জন্য নোবেল, এতদিন বাদে কেন?

জাপানের পরমাণু অস্ত্রবিরোধী সংগঠন নিহন হিদানক্যো ২০২৪ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছে, ইরানের সাম্প্রতিক পারমাণবিক অবস্থানের প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাপী নিরস্ত্রীকরণের জরুরি প্রয়োজনকে সামনে আনছে।
কেন লক্ষ্মীর পাঁচালি পাঠ করা হয় রতন টাটার সেরা উক্তি যা আপনাকে অনুপ্রাণিত করবে