বাঘেদের চলাফেরা এবং আচরণ শুধু তাদের জীবনধারণের অংশ নয়, বরং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু কখনও কখনও আমরা দেখি, বাঘ এক জঙ্গল ছেড়ে অন্য জঙ্গলে চলে যাচ্ছে। এই আচরণ প্রাকৃতিক কারণেই ঘটে, আবার মানব কার্যকলাপের ফলেও এর প্রভাব থাকতে পারে। ঝাড়গ্রামের জঙ্গল থেকে পুরুলিয়ার রাইকা পাহাড়ে বাঘিনি ‘জিনত’-র যাত্রা এমনই এক উদাহরণ। কেন বাঘেরা এই ধরনের স্থানান্তর করে, তা বোঝার জন্য বিভিন্ন দিক থেকে এই বিষয়টি বিশ্লেষণ করা জরুরি।
১. খাদ্যের সন্ধান
বাঘ সাধারণত বড় আকারের শিকার, যেমন হরিণ বা বুনো শূকর, খেয়ে বেঁচে থাকে। কোনও অঞ্চলে শিকারের অভাব দেখা দিলে তারা স্বাভাবিকভাবেই নতুন এলাকায় চলে যায়। বাঘিনী জিনতের পুরুলিয়ার দিকে চলে যাওয়ার কারণগুলির মধ্যে অন্যতম হতে পারে ঝাড়গ্রামের জঙ্গলে খাদ্যের অভাব।
২. বাসস্থানের সংকট
অরণ্য ধ্বংস এবং মানুষের অনুপ্রবেশের ফলে বাঘের বাসস্থান ক্রমশ সংকুচিত হয়ে পড়ছে। বনাঞ্চল কমে যাওয়ার কারণে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বাঘের সংখ্যা বেশি হয়ে গেলে তাদের মধ্যে সংঘর্ষের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাই, নতুন জায়গা খুঁজতে তারা স্থান পরিবর্তন করে।
৩. প্রজনন সংক্রান্ত কারণ
পুরুষ বাঘ এবং মাদি বাঘের মধ্যে মিলনের জন্য স্থানান্তর অত্যন্ত স্বাভাবিক। নতুন জায়গায় গিয়ে সঙ্গী খুঁজে প্রজাতির বিস্তার ঘটানোর প্রবণতা তাদের মধ্যে দেখা যায়। জিনত এবং যমুনা দুই বাঘিনিই অন্য অঞ্চলে সঙ্গী খুঁজতে বেরিয়ে থাকতে পারে।
৪. ঋতু পরিবর্তন
প্রাকৃতিক পরিবেশের পরিবর্তনও বাঘের গতিবিধিকে প্রভাবিত করে। শীত বা গ্রীষ্মের মতো ঋতুতে বাঘরা এমন জায়গায় চলে যেতে পারে যেখানে আবহাওয়া তাদের জন্য বেশি অনুকূল।
৫. অভ্যাসগত প্রবণতা
বাঘের একটি প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হলো তারা বড় এলাকা জুড়ে বিচরণ করতে পছন্দ করে। প্রায় ২০-৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকা তাদের বাসস্থানের জন্য প্রয়োজন হয়। এই বড় এলাকা জুড়ে চলাচল করার প্রবণতা তাদের নতুন জায়গায় পৌঁছে দিতে পারে।
৬. পুনর্বাসন সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ
মানুষের তৈরি সমস্যার কারণে অনেক সময় বাঘকে এক জঙ্গল থেকে অন্য জঙ্গলে স্থানান্তর করা হয়। মহারাষ্ট্রের তাডোবা থেকে জিনত এবং যমুনার ওড়িশার সিমলিপালে পুনর্বাসনের উদ্যোগই এর উদাহরণ। কিন্তু এই ধরনের পুনর্বাসনের পরে অনেক সময় তারা স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের স্থান খুঁজে নিতে অন্য জঙ্গলে পাড়ি দেয়।
বাঘ স্থানান্তরের প্রভাব
এক জঙ্গল থেকে অন্য জঙ্গলে বাঘের যাওয়া নতুন জায়গায় প্রাকৃতিক ভারসাম্যের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। শিকারের সংখ্যা কমে যাওয়া বা নতুন জঙ্গলের বাঘদের সঙ্গে সংঘর্ষের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। একই সঙ্গে এটি মানব-প্রাণীর সংঘর্ষের আশঙ্কাও বাড়ায়।
বন দফতরের ভূমিকা
বন দফতর এই ধরনের স্থানান্তর নিয়ন্ত্রণ এবং বাঘের সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জিনতকে পুরুলিয়া থেকে সুরক্ষিত এলাকায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা তারই একটি উদাহরণ। বাঘের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ এবং তাদের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল নিশ্চিত করা বন দফতরের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।
বাঘের স্থানান্তর একদিকে প্রাকৃতিক প্রবৃত্তি এবং অন্যদিকে মানব কার্যকলাপের ফল। তাদের চলাচলের কারণগুলি বুঝে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। আমাদের দায়িত্ব হলো, বাঘের বাসস্থান রক্ষা করা এবং তাদের নিরাপদে বেঁচে থাকার সুযোগ করে দেওয়া। কারণ, বাঘেরা শুধুমাত্র পরিবেশের সৌন্দর্য বাড়ায় না, তারা আমাদের বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় রাখার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।