আমেরিকার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় রচনা করলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত বামপন্থী নেতা জোহরান মামদানি (Zohran Mamdani)। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে তিনি নির্বাচিত হলেন নিউ ইয়র্ক সিটির প্রথম দক্ষিণ এশীয় ও মুসলিম মেয়র।
এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক লড়াইয়ে মামদানি পরাজিত করেছেন শক্তিশালী দুই রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী—প্রাক্তন নিউ ইয়র্ক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুওমো এবং রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়া-কে। নির্বাচনে মামদানী পান ৯,৪৮,২০২ ভোট (৫০.৬%), কুওমো পান ৭,৭৬,৫৪৭ ভোট (৪১.৩%), আর স্লিওয়া পান ১,৩৭,০৩০ ভোট।
এই ফলাফলকে আমেরিকান রাজনীতির এক ‘টার্নিং পয়েন্ট’ বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রভাবশালী শহরে প্রথমবারের মতো একজন ভারতীয়-মুসলিম, তাও আবার ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্ট প্রার্থী মেয়র পদে জয়ী হলেন।
ভারতীয় শিকড়, আফ্রিকার জন্ম, আমেরিকার উত্থান
জোহরান মামদানীর জন্ম উগান্ডার কাম্পালায়, এক ভারতীয় বংশোদ্ভূত পরিবারে। তাঁর মা মীরা নায়ার, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা (‘Salaam Bombay!’, ‘Monsoon Wedding’), আর বাবা মাহমুদ মামদানী, কোলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও খ্যাতনামা সমাজবিজ্ঞানী।
শৈশবে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনে পড়াশোনা করেন মামদানি। সাত বছর বয়সে নিউ ইয়র্কে চলে আসেন পরিবারসহ। পরে Bronx High School of Science-এ পড়াশোনা করে Bowdoin College থেকে ২০১৪ সালে আফ্রিকানা স্টাডিজে স্নাতক হন।
ধর্ম, সংস্কৃতি ও ব্যক্তিগত জীবন
মামদানী একজন শিয়া মুসলিম, এবং তাঁর বিশ্বাস ও মানবিক মূল্যবোধ তাঁর রাজনীতির অন্যতম ভিত্তি। তিনি বারবার বলেছেন—“আমার লক্ষ্য এমন এক নিউ ইয়র্ক গড়া, যেখানে ধর্ম, বর্ণ বা জাতি নির্বিশেষে সবার জন্য সমান সুযোগ থাকবে।”
সম্প্রতি তিনি বিয়ে করেছেন সিরিয়ার শিল্পী রামা দুয়াজি-কে, যাঁর চিত্রকর্ম ‘The New Yorker’ ও ‘The Washington Post’-এ প্রকাশিত হয়েছে। এই দম্পতির সম্পর্ককে আমেরিকায় বহুজন দেখছেন “সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রতীক” হিসেবে।
রাজনীতি: অ্যাসেম্বলিম্যান থেকে মেয়র
মেয়র হওয়ার আগে মামদানী ছিলেন নিউ ইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলির সদস্য (৩৬তম জেলা, অ্যাস্টোরিয়া ও লং আইল্যান্ড সিটি)। ২০২০ সালে তিনি প্রথম নির্বাচিত হন, এবং তখনই ইতিহাস গড়েছিলেন—প্রথম দক্ষিণ এশীয় পুরুষ, প্রথম উগান্ডায় জন্ম নেওয়া ব্যক্তি ও তৃতীয় মুসলিম হিসেবে নিউ ইয়র্ক অ্যাসেম্বলিতে প্রবেশ করেন।
ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত মামদানি ছিলেন ‘Students for Justice in Palestine’-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা। পরে স্থানীয় পর্যায়ের নানা সামাজিক আন্দোলন ও নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিয়েছেন। তাঁর মূল লক্ষ্য—আর্থিক সমতা, ভাড়া নিয়ন্ত্রণ, বিনামূল্যে পরিবহন ও সাশ্রয়ী খাদ্যনীতি।
নতুন মেয়রের প্রতিশ্রুতি
জোহরান মামদানি বলেছেন, “নিউ ইয়র্ককে আমি এমন এক শহরে রূপ দিতে চাই, যেখানে কোনও মানুষ খরচের ভারে নুয়ে পড়বে না। ভাড়া, যাতায়াত, শিক্ষা—সব কিছুই সবার নাগালের মধ্যে থাকবে।”
তিনি ঘোষণা করেছেন, মেয়র হিসেবে তাঁর অগ্রাধিকার থাকবে—
- ভাড়া স্থগিতকরণ (Rent Freeze)
- ফ্রি পাবলিক ট্রান্সপোর্ট
- সার্বজনীন শিশু যত্ন (Universal Childcare)
- সরকার পরিচালিত মুদি দোকান (City-Owned Grocery Stores)
ট্রাম্পের সমালোচনা ও মামদানীর ‘এইতিহাসিক জবাব’
নির্বাচনের আগে প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে মামদানির সমালোচনা করে বলেছিলেন, “ও জিতলে নিউ ইয়র্ক একদম ধ্বংস হয়ে যাবে।”
ট্রাম্প এমনকি কুওমোকে সমর্থনও জানিয়েছিলেন। কিন্তু ফলাফল জানিয়ে দিল—নিউ ইয়র্কের ভোটাররা পরিবর্তন চেয়েছেন।
বৈচিত্র্য ও আশার প্রতীক
জোহরান মামদানির এই জয় কেবল এক রাজনৈতিক সাফল্য নয়, বরং আফ্রিকা, এশিয়া ও আমেরিকার সংস্কৃতিকে একসূত্রে বাঁধা এক মানবিক গল্প। উগান্ডায় জন্ম, দক্ষিণ আফ্রিকায় বেড়ে ওঠা, নিউ ইয়র্কে শিক্ষা ও নেতৃত্ব—মামদানীর জীবন এখন এক বিশ্বনাগরিকের প্রতিচ্ছবি।


