শুভদীপ রায় চৌধুরী
সামনেই দোলযাত্রা। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের মানুষজন মেতে ওঠেন আনন্দের রঙে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সমসাময়িক বঙ্গে এক দিকে ছিল মুসলমান শাসনের অত্যাচার এবং অন্য দিকে ব্রাহ্মণদের জাত্যাভিমানী অহংকার। মাঝখানে সাধারণ মানুষ ছিল নিষ্পেষিত। সেই সময়ে মহাপ্রভুর সহজ সরল নামে-প্রেমে ভেসে গিয়েছিল ব্রাহ্মণ থেকে চণ্ডাল, এমনকি অন্য ধর্মের মানুষও।
চৈতন্য মহাপ্রভুর অপ্রকটের পর তাঁর আদর্শ বাঁচিয়ে তুলেছিলেন চৈতন্যের অন্যতম পার্ষদ নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর অষ্টম পুত্র বীরভদ্র গোস্বামী। এই বীরভদ্র গোস্বামীই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন খড়দহের শ্যামসুন্দরকে। এই শ্যামসুন্দরের দোলযাত্রা এক অন্য মাত্রা বহন করে আপামর ভক্তবৃন্দের কাছে।
শ্যামসুন্দর মন্দিরের গঠনশৈলী অভিনব। নাটমন্দিরের শেষ প্রান্ত থেকে মন্দিরটি দেখতে পালকির মতো। গর্ভগৃহে রুপোর সিংহাসনে অষ্টধাতুর শ্রীমতী ও শিলাময় অনন্তদেবের সঙ্গে রয়েছেন শ্রীশ্যামসুন্দর। হাতে মুরলী। প্রসন্ন গম্ভীর শান্ত মুখ। আয়ত চোখ।
৯৭৭ বঙ্গাব্দের মাঘী পূর্ণিমায় অদ্বৈত আচার্যের জ্যেষ্ঠ পুত্র অচ্যুতানন্দ গোস্বামী শ্যামসুন্দরকে কুঞ্জবাটীতে প্রতিষ্ঠা করেন। পরে নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর সহধর্মিণী জাহ্নবী দেবীর ইচ্ছায় শ্যামসুন্দরের বামে অষ্টধাতুর রাধিকামূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে কুঞ্জবাটীতে বিগ্রহসেবার যথেষ্ট জায়গার অভাব দেখা দিলে নির্মিত হয় বর্তমান শ্যামসুন্দর মন্দির। সে-ও চারশো বছরেরও বেশি আগের কথা। বর্তমানে কুঞ্জবাটীতে নিতাই-গৌর এবং বীরভদ্র গোস্বামীর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত।
প্রচলিত লোককথা অনুসারে, একই কষ্টিপাথর দিয়ে তিনটি বিগ্রহ তৈরি হয়েছিল – একটি খড়দহের শ্যামসুন্দর, একটি বল্লভপুরের রাধাবল্লভ এবং আর একটি হল সাঁইবোনার নন্দদুলাল। বল্লভ জিউ বিগ্রহে তিনি রাধারানির প্রেমাস্পদ, নন্দদুলাল বিগ্রহে প্রকাশ পেয়েছে গোপালসুলভ বাৎসল্য এবং শ্যামসুন্দর বিগ্রহে তিনি স্বয়ং পরমেশ্বর।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, খড়দহ নাট্যকার ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের জন্মভূমি এবং রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য। তবু শ্রীপাট খড়দহের খ্যাতি প্রধানত শ্যামসুন্দর মন্দিরের জন্যই। এই মন্দির স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে ‘শ্যামের বাড়ি’ বলেই বেশি পরিচিত। শ্রীশ্রীমা সারদাদেবী একবার বলেছিলেন, “ঠাকুর বলতেন, দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী, কালীঘাটের কালী আর খড়দহের শ্যামসুন্দর – এঁরা জীবন্ত হেঁটে চলে বেড়ান, কথা কন, ভক্তের কাছে খেতে চান।”
শ্রীশ্রীরাধাশ্যামসুন্দরের দোল উৎসব ধুমধাম করে পালিত হয় খড়দহে। কথা হয়েছিল মন্দিরের কোষাধ্যক্ষ শ্রী দেবমাল্য গোস্বামীর সঙ্গে। তিনি জানান, দোলের আগের দিন চাঁচড় পোড়ানো হয় যাকে আমরা ন্যাড়াপোড়া বলে থাকি। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন শ্যামসুন্দর এবং শ্রীমতী। অনুষ্ঠান শেষে তাঁরা আবার মন্দিরে ফিরে আসেন। পরের দিন ভোরবেলা দেবদোল হয়। তার পর শ্যামসুন্দর-শ্রীমতীকে চতুর্দোলায় চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় দোলমঞ্চে, সেখানে সবাই আবির দেন তাঁদের।
দেবমাল্যবাবু বলেন, প্রচুর ভক্তসমাগম হয় এই দিন এবং দোলমঞ্চে থাকাকালীন তাঁদের লুচিভোগ হয়, সঙ্গে থাকে নানা রকমের মিষ্টান্ন। তার পর বিকালবেলায় আবার মন্দিরে ফিরে আসেন শ্যামসুন্দর। সেখানে তাঁর স্নান হয়। তার পর অন্নভোগ নিবেদন করা হয়। অন্নভোগে থাকে সাদাভাত, শুক্তনি, ভাজা, তরকারি, পোলাও, চাটনি, পায়েস ইত্যাদি। এই ভাবেই ঐতিহ্যের সঙ্গে দোল উৎসব পালিত হয়ে আসছে শ্যামের বাড়িতে।