শ্রয়ণ সেন
— “তোকে কে বলেছিল টিভি খুলতে!”
— “আরে আমি কী করে বুঝব টিভি খুললেই এটা হবে।”
— “আজ যদি ভারত হেরে যায়, সব দায় তোর!”
কী অদ্ভুত জ্বালায় পড়লাম রে ভাই! শোয়েব আখতারের বাউন্সার সামলাতে না পেরে সচিন আউট হয়ে গেল। আর সব দোষটাই এসে পড়ল আমার ঘাড়ে। মা রীতিমতো শাসাচ্ছে আমায়। বুঝতে পারছি, ভারত হেরে গেলে আজ রাতে আমার খাওয়া জুটবে না!
তখন ক্রিকেটটা এই রকমই ছিল। খেলা মানেই এ রকম ভাবে আবেগে জড়িয়ে পড়তাম আমরা। তবে এটাও ঠিক যে তখন ক্রিকেটটা ছিল স্রেফ খেলাই। বিপক্ষকে হারানোর মধ্যে একটা পরম তৃপ্তি পাওয়া যেত, কিন্তু সেটা খেলার মোড়কেই। এখনকার মতো উগ্র দেশভক্তি দেখানোর জায়গা ক্রিকেট ছিল না।
ফিরে যাই সে দিনের কথায়। দিনটা ছিল শনিবার। ক্রিকেট বুঝতে শুরু করার পর আমার প্রথম ভারত-পাক ম্যাচ। ষষ্ঠ শ্রেণির ফাইনাল পরীক্ষা চলছে তখন। তবে পরীক্ষা চললেও খেলা দেখায় কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না আমার জন্য।
এখনও মনে পড়ে বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আশিস নেহরার সেই মারকাটারি স্পেলটা দেখার জন্য রাত দেড়টা পর্যন্ত জেগে ছিলাম, তার পর কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে সকালেই পরীক্ষা দিতে চলে গিয়েছি। আমার বাড়ি এই সব ব্যাপারে ভীষণই উদার। কিন্তু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ম্যাচের দিন সব উদারমনস্কতা নিমেষের মধ্যে হাওয়া হয়ে গেল।
এ দিকে রাস্তাঘাটে বেরোলে বুঝতে পারছি উত্তেজনার পারদ চড়ছে। ইংল্যান্ডকে সহজে হারিয়ে এবং নামিবিয়ার মতো দুর্বল দলকে জ্যান্ত সাবড়ে ফেলে ভারত এখন টগবগ করে ফুটছে। দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়া নিশ্চিত। তবুও সামনে যখন পাকিস্তান, তখন গোটা আবহটাই পালটে গেল। লোকজনের চিন্তাভাবনা এমন যেন বিশ্বকাপ না জিতলেও চলবে, কিন্তু পাকিস্তানকে হারাতেই হবে।
এত উদারমনস্ক বাড়িতে আমাকে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ দেখতে দেওয়া হচ্ছে না কেন? বুঝলাম ব্যাপারটা আমার পরীক্ষার জন্য নয়, বরং ‘খেলা দেখতে বসলে যদি ভারত হেরে যায়,’ এই ভয় থেকে। কিন্তু আমিও কি টিভি না চালিয়ে থাকতে পারি? নাছোড় আমি মাঝেমধ্যেই দেখার চেষ্টা করছিলাম কী হচ্ছে!
বিশ্বকাপে পাকিস্তান কিছুতেই ভালো খেলতে পারছিল না। কিন্তু তাদের সেরা ব্যাটিং পারফরম্যান্স ভারতের বিরুদ্ধেই দিল। সঈদ আনোয়ার এশিয়ার কিংবদন্তি হলেও গত কয়েক মাস ধরে তাঁর ব্যাটে রান নেই। অথচ ভারতকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন বড়ো রান করার জন্য। ওপেন করতে নেমে সেই যে মারমার কাটকাট ব্যাটিংটা শুরু করলেন, থামলেন শতরান পেরিয়ে।
আর পাকিস্তানের স্কোরও গিয়ে পৌঁছোল ২৭০-এর ও-পারে। ভাবা যায় না। জাস্ট ভাবা যায় না! যে পাকিস্তান এই টুর্নামেন্টে হল্যান্ড আর নামিবিয়ার বিরুদ্ধে আড়াইশো রান করতে কালঘাম ছুটিয়েছে, তারা ভারতের বিরুদ্ধেই কি না ২৭২ করে ফেলল!
বীরভূমের প্রভাবশালী সেই রাজনৈতিক নেতা, যিনি বর্তমানে জেলবন্দি, এই পরিস্থিতিতে হয়তো মন্তব্যই করে ফেলতেন, “একবার ডিপলি চিন্তা করো তো, এটা কি মানা যায়!”
ভারত হারছে নিশ্চিত! তাই টিভি বন্ধ। সেই সঙ্গে প্রচ্ছন্ন হুমকি, “টিভি চালালেই পিটব!”
আমার ক্রিকেটপ্রেমী মন কাঁহাতক আর খেলা না দেখে থাকতে পারে। টিভির ও-পারে কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। সচিন আর সহবাগ কেমন স্টার্ট দিল মাথায় ঢুকছে না। মায়ের অন্য ঘরে যাওয়ার সুযোগ নিয়ে একটা সময় টিভিটা টুক করে চালিয়েই দিলাম। স্কোর দেখে চক্ষু চড়কগাছ। ওয়াকার ইউনুসের ইনসুইং-এ পরাস্ত হয়ে ড্রেসিং রুমের পথে সৌরভ। কিন্তু স্কোরবোর্ড বলছে পাঁচ ওভারের মধ্যেই পঞ্চাশ তুলে ফেলেছে ভারত।
টিভি বন্ধ। এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেল, দেড় ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। প্রায় দু’ ঘণ্টা হতে চলল টিভি চালাইনি। আমি আর পারছি না। চালিয়েই দিলাম টিভি।
বাঃ, স্কোরটা দেখে বেশ স্বস্তি পেলাম। ভারত ১৭৭-এ পৌঁছে গিয়েছে মাত্র তিনটে উইকেট হারিয়ে। সচিন ব্যাট করছে ৯৮ রানে। হাতে প্রচুর ওভার বাকি, অর্থাৎ ভারতের জয় প্রায় নিশ্চিত। টিভিটা চালিয়ে রাখার অনুমতি পেয়ে গেলাম।
কিন্তু তার পরেই যে এমন অদ্ভুত অঘটন ধেয়ে আসবে, কে জানত! শোয়েবের সেই বিষাক্ত বাউন্সার সামলাতে না পেরে সচিন আউট। আনন্দের মুহূর্ত হঠাৎ করে যেন বিষাদে বদলে গেল। মায়ের সেই হুমকিতে টিভিটা তখনকার মতো আবার বন্ধ করে দিলাম।
আবার যখন চালালাম, তখন আড়াইশো পেরিয়ে গিয়েছে স্কোর। যুবরাজ আর রাহুল দ্রাবিড় ভারতের ইনিংসকে সামলে নিয়েছেন। জয় শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। টিভিটা পুরোপুরি চালিয়ে রাখার অনুমতি পেয়ে গেলাম এ বার।
এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ওয়াকার ইউনুসকে পুল করে চার মেরে ভারতকে জিতিয়ে দিলেন দ্রাবিড়। আমাদের আনন্দ আর বাঁধ মানে না। অনুভূতি এমন যেন বিশ্বকাপটাই দখল করে ফেলেছি আমরা।
না, অনেক খুঁজেও তখনকার মতো আবেগকে এখন ফিরে পাই না কিছুতেই। তার একটা বড়ো কারণ হতে পারে জীবনে কর্মব্যস্ততা বেড়ে যাওয়া। খেলা দেখার সময়ই তো বেশি করে পাওয়া যায় না। আর তা ছাড়া মাঝের কয়েকটা বছর ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ মানেই একপেশে ব্যাপারটাও নজর কাড়ত না।
তবে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে সব সময়ই তো ভারতের জয় চাই। তবে তার থেকেও বেশি করে চাই একটা হাড্ডাহাড্ডি ম্যাচ। মাঝের কয়েকটা বছরে সেই একপেশে ব্যাপারটা অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। ভারতের বিপক্ষে কোনো ভাবেই দাঁড়াতে পারত না পাকিস্তান। কিন্তু ২০২১-এর টি-২০ বিশ্বকাপ থেকে পরিস্থিতি আবার বদলাতে শুরু করেছে।
আর ঠিক সেই কারণেই ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট আবার উপভোগ্য হয়ে উঠছে। গত বছর মেলবোর্নে বিরাট কোহলির সেই ইনিংসটা এখনো মনে গেঁথে রয়েছে। এই কারণেই গেঁথে রয়েছে কারণ ম্যাচটা একপেশে ছিল না। যথেষ্ট লড়াই করে ভারতকে জিততে হয়েছিল সে দিন।
পাকিস্তান কিন্তু এখন অনেক বেশি শক্তিশালী। বর্তমানে একদিনের ক্রিকেটে এক নম্বর র্যাঙ্কিংটা ওদের দখলেই। বাবর আজম-সহ গোটা ব্যাটিং লাইন-আপ ফর্মে। শাহিন আফ্রিদি-নাসিম শাহ-হ্যারিস রাউফ সংবলিত পেস ব্যাটারি বিপক্ষকে রীতিমতো নাকানিচোবানি খাওয়াচ্ছে।
শনিবার ক্যান্ডিতে মুখোমুখি হচ্ছে ভারত ও পাকিস্তান। যা বুঝছি এই ম্যাচ কোনো ভাবেই এক তরফা হবে না। লড়াই হবে, হবেই। তবে শেষ হাসি ভারতই হাসবে সেই ব্যাপারে আশাবাদী।