ভারত: ২২৪ ও ৩৯৬ (যশস্বী জয়ওসয়াল ১১৮, আকাশ দীপ ৬৬, জোশ টাং ৫-১২৫, গাস অ্যাটকিনসন ৩-১২৭)
ইংল্যান্ড: ২৪৭ ও ৩৬৭ (হ্যারি ব্রুক ১১১, জো রুট ১০৫, মহম্মদ ৫-১০৪, প্রসিদ্ধ কৃষ্ণ ৪-১২৬)
কেনিংটন ওভাল: ওভাল টেস্টে ভারতের জয়কে যে কোন বিশেষণে আখ্যায়িত করা যায়, সেটা ভেবে কুল পাচ্ছেন না ক্রিকেটবোদ্ধারা। অভূতপূর্ব জয়, অবিশ্বাস্য জয়, অনবদ্য জয়, অনন্য জয়, ঐতিহাসিক জয় — যে বিশেষণেই এই টেস্ট জয়কে ক্রিকেটবোদ্ধারা অবিহিত করুন না কেন, কিছুতেই যেন তৃপ্ত হচ্ছেন না তাঁরা। তবে নিঃসন্দেহে এ কথা বলা যায়, এরকম টানটান উত্তেজনায় টেস্টম্যাচের ফয়সালা খুব কমই হয়েছে। আর এই ফল ক্রিকেটপ্রেমীদের যে আবার টেস্টম্যাচের প্রতি আগ্রহী করে তুলবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
জয় না হার? জয় না হার? জয় না হার? জয়
কথায় বলে, ক্রিকেট অনিশ্চয়তার খেলা। এটা যে কথার কথা নয়, তা প্রমাণ দিল এই ওভাল টেস্ট। ইংল্যান্ড তখন ১০৬ রানে ৩টি উইকেট খুইয়েছে। ভারতের সমর্থকরা তখন আশায় বুক বাঁধছেন। তাঁরা ধরেই নিচ্ছেন, এর পরে আর ৩৭৪-এর লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছোনো ইংল্যান্ডের পক্ষে সম্ভব হবে না। এইরকম ভাবনা শুরু হতেই ধীরে ধীরে খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিলেন হ্যারি ব্রুক আর জো রুট। দুজনেই সেঞ্চুরি করলেন। দলের রান পৌঁছে দিলেন ৩০১-এ। ততক্ষণে ভারতীয় সমর্থকদের আশা তিরোহিত হয়েছে। জয়ের জন্য ইংল্যান্ডের আর মাত্র দরকার ৭৩ রান, হাতে সাত সাতটা উইকেট। সেই ৩০১-এই ফিরে গেলেন ব্রুক। তার পর একে একে জেকব বেথেল আর জো রুট। ৩৬ রানের মধ্যে তিন উইকেট পড়ে গেল। একটু একটু করে আবার আশায় বুক বাঁধলেন ভারতের সমর্থকরা। চতুর্থ দিনের শেষে ইংল্যান্ড পৌঁছোল ৩৩৯ রানে। জয়ের জন্য দরকার আর মাত্র ৩৫ রান, হাতে ৪ উইকেট। আশা-নিরাশার দোলাচলে ভারতের সমর্থকরা। তবে নিরাশার পাল্লাটাই ভারী।

জিতল ভারত। উল্লসিত দল ম্যাচ শেষে ফিরছে প্যাভিলিয়নে। ছবি BCCI ‘X’ থেকে নেওয়া।
৬ উইকেটে ৩৩৯ রান হাতে নিয়ে পঞ্চম দিনে খেলা শুরু করলেন জেমি ওভারটন আর জেমি স্মিথ। প্রসিদ্ধ কৃষ্ণের পর পর দুটি বলে বাউন্ডারি মারলেন ওভারটন। রান পৌঁছে গেল ৩৪৭ রানে। আর মাত্র ২৭ রান। হাতে সেই ৪ উইকেট। ততক্ষণে ভারতের সমর্থকদের মন থেকে জয়ের আশা তিরোহিত। কিন্তু পরের ওভারেই সিরাজের আঘাত। স্মিথ বোল্ড। একটু একটু করে আবার আশা জাগছে। সিরাজ নিজের পরের ওভারে ফিরিয়ে দিলেন ওভারটনকে। ভারতীয় সমর্থকদের উল্লাস। ইংল্যান্ডের রান ৩৫৪। এখনও ২০ রান করতে হবে ইংল্যান্ডকে। আর ২টো উইকেট। এ দুটো নিতে পারলেই কেল্লা ফতে। ক্রিজে তখন গাস অ্যাটকিনসন আর জোশ টাং। দলের ৩৫৭ রানে বিদায় নিলেন টাং। এবার নামলেন জখম ক্রিস ওকস। বাঁ হাত ঝোলানো স্লিংয়ে, সোয়েটারের মধ্যে ঢোকানো।
ওকসকে অন্য প্রান্তে রেখে লড়ে গেলেন অ্যাটকিনসন। ছয় মারলেন, সিঙ্গল নিলেন। ওকসকে বাঁচিয়ে খেলতে লাগলেন। রান পৌঁছে গেল ৩৬৭-তে। যে ভাবে খেলছিলেন অ্যাটকিনসন তাতে আবার হতাশায় ডুবে যেতে লাগলেন ভারতের সমর্থকরা। আর তো মাত্র একটা ছয় মারলেই টাই। একটু আগেই একটা ছয় মেরেছেন। সুতরাং সেটা কিছু অসম্ভবও নয়। এই সময়েই মোক্ষম আঘাত হানলেন সিরাজ। অ্যাটকিনসন বোল্ড। ভারত জিতে গেল। প্রথমে বিস্ময়ে মূক সবাই। এ ভাবেও জেতা যায়। তার পর মুহূর্তের মধ্যে শুরু হল উল্লাস, শুভমন-সিরাজদের, সমর্থকদের। সত্যিই অনিশ্চয়তার খেলা এই ক্রিকেট।
খলনায়ক হতে হতে হয়ে গেলেন নায়ক
এবার এই সিরিজের নায়ক মহম্মদ সিরাজের কথায় আসা যাক। এই ম্যাচ যদি ভারত হারত তা হলে সিরাজ হয়ে যেতেন খলনায়ক। কারণ, রবিবার হ্যারি ব্রুকের ক্যাচ মিস করা। না, মিস করা ঠিক নয়, ছয় দিয়ে দেওয়া। ব্রুক তখন ১৯ রানে ব্যাট করছিলেন। ফাইন লেগ দিয়ে তুলে মারলেন প্রসিদ্ধের বল। একেবারে সীমানার ধারে দাঁড়িয়েছিলেন মহম্মদ সিরাজ। সীমানা ছেড়ে একটু ভিতরে এসে সেই বল ক্যাচ করতে কোনো ভুলচুক করলেন না। বোলার, ফিল্ডার, ভারতের সমর্থকদের মুখ হাসিতে ভরে যেতে যেতে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সিরাজ ক্যাচ নিয়ে একটু পিছিয়ে যেতে যেতে সীমানার দড়ি ছুঁয়ে ফেললেন। তার পর টাল সামলাতে না পেরে ও পারে চলে গেলেন। আউট তো নয়ই, উল্টে ছয় হয়ে গেল।

দিনের দুই নায়ক মহম্মদ সিরাজ (ডান দিকে) এবং প্রসিদ্ধ কৃষ্ণের (বাঁ দিকে) সঙ্গে অধিনায়ক শুভমন গিল। ছবি BCCI ‘X’ থেকে নেওয়া।
হতাশায় মুখ ঢেকে ফেললেন সিরাজ। তাঁর একটা ভুল ম্যাচের রঙ বদলে দিয়েছিল। সেই ব্রুক সেঞ্চুরি করলেন রুটের সঙ্গে। চতুর্থ উইকেটে যোগ করলেন ১৯৫ রান। দলের রান ১০৬ থেকে ৩০১-এ পৌঁছে দিলেন। এবং দলকে পৌঁছে দিলেন জয়ের দোরগোড়ায়। এবার সেই দোরগোড়া থেকেই ইংল্যান্ডকে ফিরিয়ে দিলেন সেই সিরাজ, নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করলেন, খলনায়ক থেকে হয়ে গেলেন নায়ক। ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংসে দখল করলেন ৫ উইকেট, তার মধ্যে ৩টিই পঞ্চম দিন সকালে। অন্য উইকেটটা প্রসিদ্ধ কৃষ্ণ।
লর্ডসের ব্যথা ভুললেন সিরাজ
আর একটা ব্যথা সিরাজের। লর্ডস টেস্টে ভারতের হার। ভারত ১৯৩ রান তাড়া করতে গিয়ে ২২ রানে হেরেছিল। সেই ম্যাচে ইংল্যান্ডকে চাপে ফেলে দিয়েছিল সিরাজের ব্যাট। ১১ নম্বরে ব্যাট করতে নেমে ৩০টা বল খেলেছিলেন ব্যাটের মাঝখান দিয়ে। রবীন্দ্র জাদেজার সঙ্গে জুটিতে দশম উইকেটে যোগ করেছিলেন ২৩ রান। শোয়েব বসিরের যে বলে আউট হন, সেটাও ব্যাটের মাঝখান দিয়েই খেলেছিলেন। বল পিচের ক্ষতে পড়ে উইকেটের দিকে চলে যায়। বলের আঘাতে উইকেটের বেল পড়ে যাওয়ায় আউট হয়ে যান সিরাজ। সিরাজ বলটা আটকাতে পারতেন। উইকেটের দিকে এগিয়ে যাওয়া বলটা ব্যাট বা পা দিয়ে সরিয়ে দিতে পারতেন। পারেননি। আউট হয়ে পিচের উপর বসে কেঁদে ফেলেছিলেন। ইংল্যান্ডের ক্রিকেটারেরা এগিয়ে এসে তাঁকে সামলেছিলেন। তাঁর লড়াইকে কুর্নিশ জানিয়েছিলেন। সেই ম্যাচের পর দু’রাত ঘুমোতে পারেননি। নিজেকে ক্ষমা করতে পারেননি।

পারল না ইংল্যান্ড। গাস অ্যাটকিনসন (ডান দিকে) আউট। সান্ত্বনা দিচ্ছেন ক্রিস ওকস। ছবি England Cricket ‘X’ থেকে নেওয়া।
সোমবার ওভালে সব কষ্টের অবসান হল সিরাজের। তিনিই হয়ে উঠলেন নায়ক এবং সত্যি কথা বলতে কী সিরিজেরও নায়ক। গোটা সিরিজ়ে ধারাবাহিক ভাবে ভাল বল করেছেন সিরাজ। ৫টা টেস্টই খেললেন। নতুন বলে উইকেট নিলেন, পুরনো বলেও। ১৮৫.৩ ওভার বল করে ২৩টা উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি হয়েছেন।।
ওভালে ভারত জিতল ৬ রানে। সিরিজ ২-২ হল। ‘প্লেয়ার অফ দ্য ম্যাচ’ হলেন মহম্মদ সিরাজ। আর ‘প্লেয়ার অফ দ্য সিরিজ’ যুগ্ম ভাবে হলেন শুভমন গিল এবং হ্যারি ব্রুক।
আরও পড়ুন
ভারত-ইংল্যান্ড ৫ম টেস্ট: ফের টসে হার, ত্র্যহস্পর্শের কোপে ভারত, আট বছর পরে করুণের অর্ধশত রান
ভারত-ইংল্যান্ড ৫ম টেস্ট: যশস্বীর অর্ধশত, অ্যাটকিনসনের ৫ উইকেট, শুভমনরা আপাতত ৫২ রানে এগিয়ে
ভারত-ইংল্যান্ড ৫ম টেস্ট: যশস্বী-আকাশ-রবীন্দ্র-ওয়াশিংটনের ব্যাটের সুবাদে জয়ের আশা দেখছে ভারত
ভারত-ইংল্যান্ড ৫ম টেস্ট: ব্রুক-রুটের শতরান, পোপদের জয় ৩৫ রান দূরে, হাতে ৪ উইকেট