Homeপ্রবন্ধএক অজানা বিপ্লবী হরিকিষণ তলোয়ার এবং কিছু কথা

এক অজানা বিপ্লবী হরিকিষণ তলোয়ার এবং কিছু কথা

প্রকাশিত

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

“শহিদ হরিকিষণ জিন্দাবাদ! তোমাকে ভুলিনি, কোনো দিনও ভুলব না…”। অতি সন্তর্পণে নিজেদের মধ্যে শ্রদ্ধায় উচ্চারণ করেছিল কয়েক জন বিপ্লবী সে দিন, শহিদ হরিকিষণের সমাধির কাছাকাছি গিয়ে। কারণ চারিদিকে ব্রিটিশ সরকার পুলিশের কড়া পাহারা।

তারিখটা ছিল ২৩ ডিসেম্বর, ১৯৩০ সাল। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে ব্রতী হয়েছেন দেশমাতৃকার অগ্নিসন্তানের দল, দিকে দিকে, প্রদেশে প্রদেশে। অবিভক্ত পঞ্জাবের লাহোরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসব। সেখানে ভাষণ দিতে এসেছেন পঞ্জাবের অত্যাচারী কুখ্যাত গভর্নর জিওফ্রে ফিৎস হার্ভে দে মন্ত মোরেন্সি সাহেব। ভিড়ে ভিড়। হঠাৎ সেই ভিড়ের মধ্যে থেকে হরিকিষণের হাতের রিভলবার গর্জে উঠল – দ্রাম, দ্রাম, দ্রাম। সঙ্গে সঙ্গে লুটিয়ে পড়ল মোরেন্সি।

এই সেই মোরেন্সি যে বিপ্লবী ভগৎ সিং, বিপ্লবী রাজগুরু এবং বিপ্লবী শুকদেবের ওপর জেলের মধ্যে অকথ্য অত্যাচার চালানোর নির্দেশ দিয়েছিল। ভগৎ সিং-এর হাতে, পায়ে, গলায় শিকল পরিয়ে রাখার নির্দেশ দেয়। এটা তো অমার্জনীয় অপরাধ, দেশপ্রেমিক বিপ্লবীদের প্রতি এটা তো চরম অপমান, চরম অত্যাচার। তাই ভগৎ সিং, রাজগুরু, শুকদেব, চন্দ্রশেখর আজাদ, বটুকেশ্বর দত্ত, আশফাকুল্লা খানের সম্মিলিত প্রয়াসে গঠিত ‘নওজোয়ান ভারতসভার’ অন্যতম সদস্য হরিকিষণ তলোয়ার সে দিন নিজের কাঁধে তুলে নেন মোর‍্যান্সিকে যোগ্য শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব।

আর সেই মতন ১৯৩০ সালের ২৩ ডিসেম্বরের এই ঘটনা।

ঘটনাস্থলেই গ্রেফতার হলেন হরিকিষণ। শুরু হল বিচারের নামে প্রহসন। ইংরেজ বিচারক ফ্রেডি স্যামুয়েল প্রাণদণ্ডের আদেশ দিলেন। হরিকিষণকে রাখা হল মিয়ানওয়ালি জেলে। ফাঁসির দিন স্থির হলো ৮ জুন ১৯৩১।

সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা গেল হরিকিষণের অন্তিম অভিলাষের কথা – “আবার ভারতে জন্মগ্রহণ করতে চাই”।

“মিয়ানওয়ালী, ১০ই জুন। হরিকিষণের আত্মীয়গণের সহিত তাহার শেষ-সাক্ষাতের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া গিয়াছে। প্রকাশ যে, গত ৮ই জুন প্রাতে হরিকিষণের আত্মীয়বর্গ মিয়ানওয়ালীতে আসিয়া উপস্থিত হন।…

বেলা ১১টা ১০ মিনিটের সময় হরিকিষণের আত্মীয়বর্গকে তাহার সহিত শেষ-সাক্ষাৎ করিবার  জন্য অনুমতি দেওয়া হয়। সাক্ষাতের সময় জেল-দারোগা এবং অন্যান্য জেল-কর্মচারীরা তথায় উপস্থিত ছিল।

হরিকিষণকে সমস্ত সময় স্ফুর্তিযুক্ত ও আনন্দিত দেখাইতেছিল। আত্মীয়গণের সহিত কিছুক্ষণ পারিবারিক কথাবার্তা চলিবার পর তাহার শেষ ইচ্ছা সম্বন্ধে কিছু বলিবার আছে কিনা জানিতে চাওয়া হয়।

প্রকাশ, এই প্রশ্নের উত্তরে হরিকিষণ বলে: “মাতৃভূমির শৃঙ্খল-বন্ধন মোচন করিবার জন্য যেন পুনরায় ভারতে জন্মগ্রহণ করি, এই আমার ইচ্ছা। আমি দেশের দীন সেবক মাত্র। যদি আপনাদিগকে আমার মৃতদেহ সমর্পণ করা হয়, তবে শতদ্রু নদীর তীরে যে স্থানে ভগৎ সিং, রাজগুরু ও শুকদেবের অন্ত্যেষ্টি-ক্রিয়া সম্পন্ন হইয়াছে, সেইস্থানে আমারও যেন অন্ত্যেষ্টি-ক্রিয়া সম্পন্ন হয়…।”

কী ঘটেছিল তার পর, সেটা জানা যাক।

সারা বিশ্ব জানে, মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত বন্দির অন্তিম বাসনা পূর্ণ করা যে কোনো সভ্য রাষ্ট্রের উচিত রীতি। কিন্তু শহিদ হরিকিষণের ক্ষেত্রে সে দিন তা হয়নি। এমনকি প্রচলিত ধর্মমত উপেক্ষা করেই মুসলমানদের কবরখানায় তাঁর মৃতদেহ সৎকার করতেও সে দিন তথাকথিত ব্রিটিশ সরকারের এতটুকু বাধেনি।

ভারত মায়ের বিপ্লবী শহিদ সন্তান হরিকিষণ তলোয়ারের মৃতদেহ সৎকারের পুরো সংবাদ প্রকাশ করে ১৯৩১ সালের ১৫ জুন আনন্দবাজার পত্রিকা লিখেছিল – “হরিকিষণের মৃতদেহ সৎকার সম্বন্ধে বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া গিয়াছে। প্রকাশ যে, মিয়ানওয়ালী জেলের পাশেই যে স্থানে বেওয়ারিশ মুসলমান কয়েদীগণকে কবর দেওয়া হয়, সেইস্থানে গভীর রাত্রিতে কড়া পুলিশ পাহারায় হরিকিষণের মৃতদেহ সৎকার করা হইয়াছে।”

আজ ভারতবর্ষ স্বাধীন। ৭৫ বছর অতিক্রান্ত। কিন্তু অমর শহিদ হরিকিষণ তলোয়ারের নাম আমরা জানি না। জানি না তাঁদের আত্ম-বলিদানের ইতিহাস। সেই বেদনায় আমাদের অতীত ইতিহাস বোধহয় বোবা হয়ে গেছে। কবিগুরুর বাণীতে অমর শহিদের প্রতি রইল প্রণাম – “কথা কও, কথা কও।/ অনাদি অতীত, অনন্তরাতে কেন চেয়ে বসে রও?/ কথা কও, কথা কও।”

এখানে উল্লেখ্য, হরিকিষণের ছোটো ভাই ভগতরাম তলোয়ার ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মহানিষ্ক্রমণের অন্যতম সঙ্গী এ দেশ থেকে আফগানিস্তানের কাবুল পর্যন্ত।

তথ্যসূত্র:

সবার অলক্ষ্যে – ভুপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত রায়

আমি সুভাষ বলছি – শৈলেশ দে

আপনার প্রশ্ন, আমাদের উত্তর

সাম্প্রতিকতম

নির্বাচনে ২৩৭ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করল বিএনপি, তিন আসনে লড়বেন খালেদা জিয়া, নির্বাচনে নামছেন ছেলে তারেক রহমানও

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রার্থী ঘোষণা করল বিএনপি। ২৩৭ আসনে একক প্রার্থী দিচ্ছে দলটি। তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন খালেদা জিয়া, বগুড়া-৬ থেকে নির্বাচনে নামছেন তারেক রহমান।

পাকিস্তান-সহ ৪ দেশ পরমাণু গোপনে পরমাণু পরীক্ষা চালাচ্ছে, তাই আমেরিকাও শুরু করবে, জানিয়ে দিলেন ট্রাম্প

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করলেন, পাকিস্তান-সহ একাধিক দেশ গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা চালাচ্ছে। তাই ৩০ বছর পর আমেরিকারও পারমাণবিক পরীক্ষা ফের শুরু করা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন তিনি।

সাত বছর পর ঘরে ফেরা! তৃণমূলে ফিরলেন শোভন চট্টোপাধ্যায়, সঙ্গে বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়

দীর্ঘ সাত বছর পর আবার তৃণমূলে ফিরলেন কলকাতার প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। সোমবার দুপুরে তৃণমূল ভবনে সুব্রত বক্সী ও অরূপ বিশ্বাসের হাতে উত্তরীয় পরে আনুষ্ঠানিক প্রত্যাবর্তন করলেন তিনি ও বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়।

তেলঙ্গানায় ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা! লরির সঙ্গে বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে মৃত অন্তত ২৪, বহু আহত

তেলঙ্গানার রঙ্গা রেড্ডি জেলায় ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ২৪ জনের মৃত্যু। ভারী লোড-বোঝাই লরি মুখোমুখি ধাক্কা দেয় রোড ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশনের বাসকে। আহতদের হাসপাতালে ভর্তি, দুর্ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও মুখ্যমন্ত্রী রেবন্ত রেড্ডি।

আরও পড়ুন

কত দূরের, তবু কত কাছের তিনি – উত্তমকুমার

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায় ১৯২৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর, আহিরীটোলার বাপের বাড়িতে শ্রীমতী চপলা দেবী জননী হলেন। অত্যন্ত...

স্বাধীনতা আন্দোলনের অলিখিত ইতিহাস: ভুলে গিয়েছি অগ্নিস্নাত বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষকে  

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায় মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করেননি। বিধানচন্দ্র রায়কে আশীর্বাদও করেননি। বল্লভভাই পটেলের...

স্বাধীনতা আন্দোলনের অলিখিত ইতিহাস: ‘এবার তবে আসি মা!’

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায় একটা সুবৃহৎ দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস এত পক্ষপাতিত্ব করে লেখা হয়েছে, যার উদাহরণ...