Homeকথাশিল্পরবীন্দ্রনাথের ‘রাখীসঙ্গীত' এবং তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত

রবীন্দ্রনাথের ‘রাখীসঙ্গীত’ এবং তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত

প্রকাশিত

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর গানের সংকলন গ্রন্থ গীতবিতানের গানগুলি সাজিয়েছিলেন। সেই গীতবিতানের প্রথম খণ্ডে স্বদেশ পর্যায়ের ৪৬টি গানের মধ্যেই রয়েছে ‘রাখীসঙ্গীত’টি। এই গানটির একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত আছে। ১৯০৫ সালে অবিভক্ত বাংলার মানচিত্রকে দ্বিখণ্ডিত করার যে সিদ্ধান্ত সেই সময়ের শাসক ব্রিটিশ গ্রহণ করেছিল, তার বিরুদ্ধে সারা বাংলা জুড়ে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়। ১৩১২ বঙ্গাব্দের ৯ ভাদ্র তৎকালীন ভারতবর্ষের রাজধানী কলকাতার টাউন হলে আয়োজন করা হয়েছিল একটি প্রতিবাদসভা। সেই সভায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন। সেই প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল, ‘অবস্থা ও প্রতিকার’। সে দিনের সেই প্রবন্ধে পরবর্তী আন্দোলনের পদক্ষেপ ও পথনির্দেশিকা ছিল। সে দিন টাউন হল জনসমাগমে উপচে পড়েছিল।

এর পর রবীন্দ্রনাথ কয়েক দিনের জন্য গিরিডিতে চলে গিয়েছিলেন। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলন তখন তীব্র আকার নিয়েছিল সারা দেশ জুড়ে। চলেছিল তুমুল আকারে বিদেশি পণ্য বয়কট আন্দোলন।

এই গিরিডিতে (অধুনা ঝাড়খণ্ড রাজ্যে) থাকাকালীন তিনি অধিকাংশ স্বদেশি গান এবং কবিতা রচনা করেছিলেন আর সেই সব গান ও কবিতাগুলি ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় (আশ্বিন, ১৩১২ বঙ্গাব্দ সংখ্যায়) এবং ‘ভাণ্ডার’ পত্রিকায় (ভাদ্র-আশ্বিন, ১৩১২ বঙ্গাব্দের সংখ্যায়) প্রকাশিত হয়েছিল। সেই গান ও কবিতাগুলির মধ্যে রয়েছে ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’, ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ (রাখিসংগীত), ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ প্রভৃতি ১১খানি গান।

সেই যুগের বাংলা তথা ভারতবর্ষে স্বদেশি আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এই সকল গান দেশবাসীর মনের মধ্যে স্বদেশি প্রেম, জাতীয়তাবাদের অনুভব জাগাতে যে ভুমিকা পালন করেছিল তার ঐতিহাসিক মূল্য এবং মর্যাদা অপরিসীম।

স্বদেশি আন্দোলনের সময়ে অবিভক্ত বাংলার সমস্ত জায়গায় শত সহস্র জনসভায়, হাটে-মাঠে-বাটে, ঘরে-বাইরে, পথে-ঘাটে এই গানগুলি বন্দেমাতরম-এর সঙ্গে গাওয়া হত সুদৃঢ় অঙ্গীকারের বলিষ্ঠতায়। যে দিন আনুষ্ঠানিকভাবে অবিভক্ত বাংলার মানচিত্রের ব্যবচ্ছেদ ব্রিটিশ করতে চেয়েছিল (১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর), সেই দিন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ সকলকে নিয়ে নেমেছিলেন পথে। সবাইকে নিয়ে এই ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানটি গাইতে গাইতে, হাঁটতে হাঁটতে পথচারীদের হাতে রাখি পরিয়ে দিয়েছিলেন। সঙ্গে নিয়েছিলেন কলকাতার প্রাচীন নাখোদা মসজিদের ইমাম সাহেবকেও। ইমাম সাহেবের হাতে রাখি পরিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ইমাম সাহেবও বিনম্রতায় রবীন্দ্রনাথের হাতে রাখি পরিয়ে দিয়েছিলেন। এই প্রেক্ষিতেই এই বিশেষ গানটি ‘রাখীসঙ্গীত’ হিসেবে ঐতিহাসিকতার দাবি করতেই পারে। (তথ্যসূত্র: অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর ‘ঘরোয়া’ গ্রন্থ)।

এখানে তাই বলা যায়, যে স্বদেশ পর্যায়ের অন্যতম গান ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে’ এবং ‘আমার সোনার বাংলা’ আজ আমাদের দেশ ভারতবর্ষের এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসাবে প্রতিষ্ঠিত এক অনন্য অভিজ্ঞানের প্রেক্ষিতে। সেই রকম ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানটিও এক অনন্য অভিজ্ঞান-এর দাবি রাখে। সেই নিরিখে বলা যায় যে যদি ‘জনগণমন’ এবং ‘আমার সোনার বাংলা’ গানদুটি অপরিবর্তনীয় বলে সম্মান পেতে পারে, তা হলে এই ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানটিও সেই একই ঐতিহ্যের সম্মান দাবি করতেই পারে। তার ওপর কলমীয় আক্রমণ কোনো ভাবেই ইতিহাস মেনে নিতে পারবে না।

ইতিহাসের প্রসঙ্গেই বলা যায়, মূল গানটি আট পঙক্তির। তার প্রথম চার পঙক্তিতে বাংলাকে নিয়ে এবং পরের চার পঙক্তিতে বাংলার মানুষের মানে বাঙালিকে নিয়ে সমভাবে প্রযুক্ত। প্রথম চার পঙক্তিতে রয়েছে বাংলার প্রকৃতি তথা মাটি-জল-বায়ু-ফল-ঘর-হাট-বন-মাঠের কথা। এই সব বাংলার নৈসর্গিক রূপ সম্পর্কিত। আর পরের চার পঙক্তিতে রয়েছে বাঙালির পণ-আশা-কাজ-ভাষা-মন-প্রাণ-ভাই-বোনের কথা, যা বঙ্গভূমিতে বসবাসকারী মানুষদের বিশেষ শুভকামনায় বর্ণিত।

এই গানটির মধ্যে একটি নৈতিক মূল্য কেন্দ্রীয়ভাবে আক্ষিপ্ত আছে, যা এক পরম কাঙ্ক্ষিত ঐক্যের সুর ও ঐতিহ্য বহন করে। ‘বাঙালির ঘরে যত ভাই-বোন’ তারা সকলেই ‘এক হউক এক হউক,’ – এই শুভ প্রার্থনা।

এ কথা তো সত্য যে, রবীন্দ্রনাথের অন্তরে, ভাবনায়, মননশীলতায় তাঁর ‘মর্মে গাঁথা’ ছিল ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার ‘পরে ঠেকাই মাথা, তোমাতে বিশ্বময়ীর, তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা’ – সেই ‘শ্যমলবরণ কোমল মূর্তি’-র নকশিকাঁথায় কোনো সংকীর্ণতার ঠাঁই নেই। এই ভারতবর্ষ, ‘এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে,..দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবেনা ফিরে’, যেমন, ঠিক তেমনই, এই বাংলার মাটিতে ‘বাঙালির ঘরে যত ভাই-বোন’ তাদের সকলের সম্মিলিত অস্তিত্ব এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের সেই ঐতিহাসিক ঐক্যের একতারাটির, দোতারাটির মূল সুর নিহিত আছে।

তাই রবীন্দ্রনাথ অনাক্রম্যই থাকুন। তিনি অত্যন্ত সূক্ষ্ম, অত্যন্ত সংবেদনশীল, আমাদের অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক সাবলীল গৌরবের আনন্দ। তাঁকে কলমীয় আক্রমণ, ব্যবচ্ছেদ করা কোনোমতেই কাঙ্ক্ষিত নয়, শুভচিন্তার পরিচায়ক নয়।

সাম্প্রতিকতম

আন্দোলনরত কৃষকদের চণ্ডীগড়ে বৈঠকে আমন্ত্রণ জানাল কেন্দ্র

১৪ ফেব্রুয়ারি চণ্ডীগড়ে কেন্দ্রীয় সরকারের আমন্ত্রণে কৃষকদের সঙ্গে বৈঠক। এমএসপি সহ কৃষকদের দাবি নিয়ে আলোচনা হবে।

‘আইআইটিয়ান বাবা’ অভয় সিংহ জুনা আখড়া থেকে বহিষ্কৃত, গুরু অবমাননার অভিযোগ

আইআইটি বম্বের প্রাক্তনী এবং "আইআইটিয়ান বাবা" নামে পরিচিত অভয় সিংহ গুরু অবমাননার অভিযোগে জুনা আখড়া থেকে বহিষ্কৃত। আখড়া শৃঙ্খলা লঙ্ঘনের অভিযোগে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সইফ আলি খানের উপর হামলাকারী ‘বাংলাদেশি নাগরিক’, ভারতে এসে নামও পরিবর্তন করে, জানাল পুলিশ

সাইফ আলি খানের মুম্বইয়ের বাড়িতে ডাকাতির চেষ্টা ও হামলার ঘটনায় অভিযুক্ত একজন বাংলাদেশি নাগরিক। মুম্বই পুলিশ জানিয়েছে, অভিযুক্ত ব্যক্তি অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করেছিলেন।

রুবি পার্ক দিল্লি পাবলিক স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠান

কলকাতা: রুবি পার্ক দিল্লি পাবলিক স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠান হল শনিবার গীতাঞ্জলি স্টেডিয়ামে। এটি...

আরও পড়ুন

কাব্য প্রতিভায় উদ্ভাসিত স্বামী বিবেকানন্দ

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায় ছাত্রাবস্থায় নরেন্দ্রনাথ গভীর অধ্যয়নে ওয়ার্ডসওয়ার্থ, মিলটন, শেলি, কিটস- এর কবিতা খুব গভীর ভাবে...

সেদিন গরিব মানুষের প্রতি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মমত্বের পরিচয় পেয়েছিলাম

অনিল কুণ্ডু, সাংবাদিক, গণশক্তি "ক্ষতিগ্রস্ত আর্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।...

সুড়ঙ্গ থেকে শ্রমিকদের উদ্ধার করে মুন্না, ফিরোজরা মনে করিয়ে দিলেন জন হেনরিকে – ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ওই…’

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায় ‘মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না,...
কেন লক্ষ্মীর পাঁচালি পাঠ করা হয় রতন টাটার সেরা উক্তি যা আপনাকে অনুপ্রাণিত করবে