শম্ভু সেন
“আমার যৌবন ও প্রৌঢ় বয়সের সাহিত্যরসসাধনার তীর্থস্থান ছিল পদ্মা-প্রবাহ-চুম্বিত শিলাইদহ পল্লীতে” – তিরোধানের এক বছর আগে শিলাইদহ পল্লীসাহিত্য সম্মেলনের সম্পাদককে লেখা এক চিঠিতে এই উক্তি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কবির জীবনে শিলাইদহের স্থান ঠিক কোথায় ছিল তা তাঁর এই উক্তিতেই সুস্পষ্ট।
রবীন্দ্রনাথের বিবাহের দিন স্থির। তার ঠিক দু’ দিন আগে পুত্রের কাছে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্দেশ এল: “এইক্ষণে তুমি জমিদারির কার্য্য পর্যবেক্ষণ করিবার জন্য প্রস্তুত হও।” বাবামশায়ের সেই আদেশ কার্যকর হতে অবশ্য আরও বছর ছয়েক সময় লাগল। পূর্ববঙ্গের শিলাইদহ-সাজাদপুর-পতিসরের জমিদারি পরিদর্শনের ভার নিয়ে কবি শিলাইদহে এলেন ১৮৯০-এর গোড়ায়। ৩২ বছর ধরে পদ্মাপারের এই অঞ্চলের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলেন কবি। যেমন নিষ্ঠার সঙ্গে জমিদারি দেখাশোনা করেছেন, তেমনই মেতেছিলেন সৃষ্টির আনন্দে। লিখেছিলেন গান, কবিতা, নাটক, গল্প, চিঠিপত্র। কবির এই সৃষ্টি-সম্ভার থেকে বেছে নিয়ে সে দিন ২১টি গান পরিবেশন করল ‘বৈতালিক’।
‘বৈতালিক’-এর ২১ বছর পূর্ণ হল। সেই উপলক্ষ্যে সম্প্রতি রবীন্দ্র সদনে ‘বৈতালিক’ পরিবেশন করল ‘পদ্মাপারের গান’। একই সঙ্গে সংবর্ধনা জানানো হল রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী বিভা সেনগুপ্তকে।
ঘড়ির কাঁটা ধরে ঠিক সন্ধ্যা ৬টায় শুরু হয় এ দিনের অনুষ্ঠান। সূচনায় বৈতালিক শিল্পীগোষ্ঠী চারটি গান পরিবেশন করে – ‘আজি এ আনন্দসন্ধ্যা’, ‘মোর সন্ধ্যায় তুমি’, ‘এই লভিনু সঙ্গ তব’ এবং ‘তুমি যে সুরের আগুন’। এ দিনের মূল অনুষ্ঠান ঠিক কোন উচ্চতায় পৌঁছে যাবে তা বোঝা গিয়েছিল সম্মেলক গানের নিখুঁত পরিবেশনার মাধ্যমেই।
সম্মেলক উদ্বোধনী সংগীতে অনুষ্ঠানের সূচনা।
অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে ছিল বিভা সেনগুপ্তকে সংবর্ধনা। রবীন্দ্রসংগীত জগতের এক প্রতিভাধর শিল্পী বিভা সেনগুপ্ত এখন নব্বই ছুঁই-ছুঁই। আগরতলার মেয়ে বিভা। সংগীতজীবনের একেবারে গোড়ার দিকে নানা ধরনের গানের শিক্ষা নিয়েছিলেন। গত শতকের পাঁচের দশকে আগরতলা থেকে চলে আসেন কলকাতায়। রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষা শুরু করেন ‘অ্যাকাডেমি অফ ডান্স ড্রামা মিউজিক’-এ, বর্তমানে যা রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। এখানেই শিক্ষক রূপে পেয়েছিলেন মায়া সেনকে। তাঁর কাছে বিভা ব্যক্তিগত ভাবে তালিম নিতে শুরু করেন। এবং মায়া সেনের সূত্র ধরেই পৌঁছে যান দেবব্রত বিশ্বাসের কাছে। তাঁর কাছেও রবীন্দ্রসংগীত শেখেন বিভা সেনগুপ্ত।
বিভা দেবীকে উত্তরীয় পরিয়ে এবং পুষ্পস্তবক দিয়ে সম্মাননা প্রদান করেন বৈতালিকের পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার দেবারতি সোম ও স্বপন সোম। স্বপনবাবু তাঁর বক্তৃতায় বলেন, অত্যন্ত গুণী শিল্পী বিভা সেনগুপ্ত। অথচ অনেকেই তাঁকে চেনেন না। এই নব্বই ছুঁই-ছুঁই বয়সেও যে অনায়াস দক্ষতায় তিনি গান করেন তা বিস্ময় জাগায়। এখনও তাঁর গান তার সপ্তকের পঞ্চম ছুঁয়ে যায়। স্বপনবাবু বলেন, “সকলেই শিল্পী হন না। আমরা বেশির ভাগই গায়ক গায়িকা। কিন্তু বিভাদি শিল্পী।” বিভা সেনগুপ্তকে মানপত্র প্রদান করা হয়। মানপত্রটি পাঠ করেন আশিস চক্রবর্তী। সংবর্ধনার উত্তরে বিভা সেনগুপ্ত তাঁর ছোট্ট ভাষণে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। বলেন, “আমি আনন্দিত। সংবর্ধনা পাওয়ার কতটা যোগ্যতা আমার আছে আমি জানি না। স্বপন আর দেবারতি সোমের বৈতালিক আমাকে সংবর্ধনা জানাল।”
এর পরে বিভা দেবী গাইলেন ‘আমি হেথায় থাকি শুধু গাইতে তোমার গান’। এবং কিছুক্ষণ আগে স্বপনবাবুর বলা কথার প্রমাণ দিলেন। এই বয়সেও তাঁর কণ্ঠ তারসপ্তকের কোথায় যে ছুঁয়ে গেল! শ্রোতা-দর্শককুল বিস্মিত। তাঁরা তুমুল করতালি দিয়ে নবতিপর শিল্পীকে অভিবাদন জানালেন।
বিভা সেনগুপ্তকে সম্মাননা প্রদান করছেন স্বপন সোম ও দেবারতি সোম।
সামান্য বিরতি দিয়ে শুরু হল দ্বিতীয় পর্ব। ‘পদ্মাপারের গান’ হিসাবে প্রথম পরিবেশিত হল সম্মেলক গান ‘আমারে কে নিবি ভাই’। ১২৯৬ বঙ্গাব্দের ফাল্গুনে সাজাদপুরে এসে ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসের প্রথমাংশ অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথ লিখে ফেললেন ‘বিসজর্ন’ নাটক। সেই নাটকেরই গান ‘আমারে কে নিবি ভাই’।
শিলাইদহে থাকাকালীন আরও নাটক লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘রাজা’। স্বপন সোমের গলায় শ্রোতা-দর্শকরা মুগ্ধ হয়ে শুনলেন ‘কোথা বাইরে দূরে’। পরিবেশিত হল সম্মেলক গান – ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে’। এর পর স্বপন সোম পরিবেশন করলেন ‘আমি তোমার প্রেমে হব সবার কলঙ্কভাগী’। মন ভরে গেল শ্রোতা-দর্শকদের।
এই শিলাইদহ-পর্বেই কবি লিখেছিলেন ‘অচলায়তন’ নাটক। ‘অচলায়তন’-এর কাহিনি মূলত পঞ্চকের কাহিনি। অচলায়তনের মন্ত্র-তন্ত্র, আচার-আচমন সূত্র-বৃত্তি – কিছুই শেখা হয়ে ওঠে না পঞ্চকের। পঞ্চক মানেই মুক্তি, সহজ স্ফূর্তি। সে নৃত্যগীতে মেতে যায়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সে স্পর্ধাপূর্বক আচার লঙ্ঘন করেছে। তাই তাকে দর্ভকপল্লিতে নির্বাসন দেওয়া হয়। ‘অচলায়তন’ থেকে এ দিন তিনটি গান পরিবেশিত হল। প্রথমে সম্মেলক গান ‘ওরে ওরে ওরে আমার মন মেতেছে’। এর পর দেবারতি সোমের দুটি গান, ‘এই মৌমাছিদের ঘরছাড়া কে করেছে রে’ এবং ‘ও অকূলের কূল’ আবিষ্ট করল শ্রোতা-দর্শকদের।
শিলাইদহ থেকে ১৮৮৮-এর নভেম্বরে ভাইঝি ইন্দিরাকে কবি লিখলেন, “পৃথিবী যে বাস্তবিক কত সুন্দরী তা কলকাতায় থাকলে ভুলে যেতে হয়।” কবি শিলাইদহে এসে তা বুঝতে পেরেছিলেন। বছর সাতেক পরে ১৮৯৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ভাইঝিকে লিখছেন, “আজ সেই ঝড়ের ভাবটা থেমে গিয়ে সকালে অল্প অল্প রোদ্দুর ওঠার চেষ্টা করছে…। মেঘ আকাশময় ছড়ানো, পুবে হাওয়া বেগে বইছে।…এখান থেকে দূরের পদ্মার গর্জন শোনা যাচ্ছে। কাল পরশু দুদিন ঠিক আমার নতুন গানের মতো দৃশ্যটা হয়েছিল…”। পরিবেশিত হল সম্মেলক গান ‘ঝর ঝর বরিষে বারিধারা’। এর পরেই সম্মেলক গান ‘হেরিয়া শ্যামলঘন’। ১৮৯৭-এর শরতে ইছামতী নদী দিয়ে শিলাইদহ থেকে সাজাদপুর যাওয়ার সময় ঝড়বৃষ্টির মাঝে কবি এই গান লিখেছিলেন।
১৯০৯ সালে চারুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় এলেন শিলাইদহে। আগে থেকেই রয়েছেন অজিত কুমার চক্রবর্তী। একদিন আড্ডা বসেছে। কবি বললেন, গান ধরো। বলে নিজেই গান ধরলেন – ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’। সেই গান শ্রোতা-দর্শকরা শুনলেন দেবারতি সোমের কণ্ঠে। অপূর্ব পরিবেশনা। ‘পদ্মাপারের গান’-এ এর পরে ছিল সম্মেলক গান ‘আজ বুকের বসন ছিঁড়ে ফেলে’।
সাজাদপুরে থাকার সময় ১৮৯৩ সালের ১০ জুলাই কবি লিখলেন ‘বড়ো বেদনার মতো বেজেছ’। এই গান নিয়ে বেশ একটা তৃপ্তি ছিল কবির মনে। ভাইঝি ইন্দিরাকে লিখেছিলেন, “সুরটা যে মন্দ হয়েছে এমন আমার বিশ্বাস নয়, এমন-কি ভালো হয়েছে বললে খুব বেশি অত্যুক্তি হয় না।… এটা যে আমার একটা প্রিয় গান সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।” গানটি পরিবেশন করলেন স্বপন সোম। এর পরে দেবারতি সোমের কণ্ঠে শোনা হল ‘বেলা গেল তোমার পথ চেয়ে’।
‘পদ্মাপারের গান’-এ সম্মেলক গান পরিবেশনা।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের বোন অমলা দাস কবিপত্নী মৃণালিনীকে কাকিমা বললেও দু’জনে ছিলেন সখীর মতো। অমলা শিলাইদহে থাকার সময় কবি লেখেন ‘ওলো সই ওলো সই’। সম্মেলক গান হিসাবে পরিবেশিত হল। এর পরে দেবারতি সোম ‘আজি যে রজনী যায়’ গেয়ে মুগ্ধ করলেন শ্রোতা-দর্শকদের।
১৩০৪ বঙ্গাব্দের আশ্বিনে কবি শিলাইদহে বোটে ঘুরতে ঘুরতে লিখেছেন ‘বঁধু মিছে রাগ কোরো না’। পরিবেশন করলেন স্বপন সোম। প্রেমের এই গানে ভালোবাসার পরশ প্রত্যক্ষ। তবে বছর চোদ্দো পরে শিলাইদহে লেখা একটি গানে ভালোবাসা যেন আরও স্পষ্ট – ‘তুমি একটু কেবল বসতে দিও কাছে’। স্বপন সোমের অনবদ্য পরিবেশনা।
১৩২৮ সনের ৮ চৈত্র তথা ১৯২২-এর মার্চে রবীন্দ্রনাথ শেষ বার শিলাইদহে যান। ঠাকুর পরিবারের বৈষয়িক ভাগাভাগি অনুসারে সে সময় ভাইপো সুরেন্দ্রনাথের উপর শিলাইদহের জমিদারি দেখাশোনার ভার বর্তায়। ৫ এপ্রিল রাণুকে তাঁর ভানুদাদা লেখেন, “আগে পদ্মা কাছে ছিল – এখন নদী বহু দূরে সরে গেছে…। অথচ একদিন এই নদীর সঙ্গে আমার কত ভাব ছিল…।… সে নদী যেন আমাকে চেনে না।” শিলাইদহে থাকাকালীন ১০ থেকে ১৪ চৈত্রের মধ্যে পাঁচখানি গান লেখেন কবি। সব গানগুলোতেই ছিল বিদায়ের সুর, বিদায়ের বেদনা। তার মধ্যে চারটি গান পরিবেশনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে। এর মধ্যে সম্মেলক গান হিসাবে পরিবেশিত হয় ‘নিদ্রাহারা রাতের এ গান’। দেবারতি সোম পরিবেশন করেন ‘পূর্বাচলের পানে তাকাই’, স্বপন সোম পরিবেশন করেন ‘কার যেন এই মনের বেদন’ এবং দ্বৈত কণ্ঠে ‘আসাযাওয়ার পথের ধারে’ পরিবেশন করে অনুষ্ঠান শেষ করেন দেবারতি ও স্বপন সোম।
আবৃত্তিকার বাচিক শিল্পী বিজয়লক্ষ্মী বর্মনের ভাষ্যপাঠে সমগ্র অনুষ্ঠানটি প্রাণময় হয়ে ওঠে। অনুষ্ঠানের শেষে শিল্পীকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। এ দিনের অনুষ্ঠানে সম্মেলক গানে ছিল বৈতালিক শিল্পীগোষ্ঠী। যন্ত্রানুষঙ্গে ছিলেন স্বাগতম দাস, অনিকেত চক্রবর্তী, দেবাশিস হালদার এবং অমল সরকার। সমগ্র অনুষ্ঠানটি পরিচালনা দেবারতি সোম।
বৈতালিকের অনুষ্ঠান মানেই অন্য রকম প্রাপ্তি। সে দিনও তার অন্যথা হল না। অনুষ্ঠান শেষে রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে স্বপন সোম কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়েই বলেন, “রবীন্দ্রনাথ আমাদের কী দিয়ে গেছেন সে কথা যেন ভুলে না যাই।” রবীন্দ্রনাথের জীবনে জন্মনগরী কলকাতা ও কর্মক্ষেত্র শান্তিনিকেতনের পরেই তাঁর সাহিত্য-সাধনপীঠ শিলাইদহের স্থান। এ দিন তাদের প্রাণবন্ত ও মনোমুগ্ধকর পরিবেশনার মাধ্যমে সে কথাই স্মরণ করিয়ে দিল ‘বৈতালিক’।
আরও পড়ুন
সংগীতজীবনের ষাট বছর পূর্তিতে আয়োজিত ‘প্রভাতী-সন্ধ্যা’য় প্রভাতী মুখোপাধ্যায়ের অনন্য পরিবেশনা