বেশ ফুরফুরে মেজাজে বিজেপি। হাবভাব এমন যেন ভোটের আগেই জিতে বসে আছেন বিজেপি কর্মী-সমর্থকেরা! চলতি বছরের গোড়া থেকে যা চলল, তারই সুফল ঘরে তোলার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে গেরুয়া শিবির। আর শাসক দল? তৃণমূল কংগ্রেসের স্থানীয় নেতৃত্বের একাংশ নিয়ে ফেলেছেন বিশেষ এক কৌশল। আর তা হল সরল স্বীকারোক্তি। হ্যাঁ, সন্দেশখালির বহুচর্চিত ঘটনাপ্রবাহকে নিজেদের মতো করে স্বীকার করে নিয়ে জনতার কাছে মমতার হাত শক্ত করার আবেদন নিয়ে তাঁরা আগের মতোই পৌঁছে যাচ্ছেন ঘরে ঘরে।
সন্দেশখালি, শেখ শাহজাহান, শিবু হালদার, উত্তম সর্দার, অজিত মাইতি, জমি কেলেঙ্কারি, ভেড়িকাণ্ড, মা-বোনেদের আন্দোলনের মতো বেশ কিছু নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে উত্তাল রাজ্য-রাজনীতি। আর ধর্ষণ? বিজেপি বলছে, একশো শতাংশ সত্য। সিপিএম বলছে, যা রটে, কিছুটা তো ঘটে। আর তৃণমূলের একাংশের মতে, এক বালতি দুধে এক ফোঁটা চোনা।
হাতে আর কয়েকটা মাত্র দিন। সন্দেশখালিতে এখন রাজনীতির অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র। শাসক হোক বা বিরোধী। বিনা বাধায় প্রচার চালাতে কোনো সমস্যাই নেই। এটাই না কি মাসখানেক আগেও সন্দেশখালির স্থানীয় রাজনীতি থেকে মুছে গিয়েছিল। শাহজাহান আর তাঁর তথাকথিত বাহিনীর দাপটে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল বিরোধীরা। শুধু তা-ই নয়, তৃণমূলে যাঁরা শাহজাহানের ‘অপকর্ম’ মেনে নিতে পারেননি, তাঁদেরও তুচ্ছতাচ্ছিল্যের স্বীকার হতে হত। সেই পরিস্থিতিটাই এখন আমূল বদলে গিয়েছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে গত জানুয়ারি থেকে ঘটে চলা সন্দেশখালি কাণ্ডর জন্য।
সন্দেশখালি বাজারে উত্তম সর্দারের পার্টি অফিস এখনও লোক গমগমে। তবে মুখগুলো না কি বদলে গিয়েছে। শাহজাহানরা গারদে ঢুকতেই ময়দানে নেমেছেন তৃণমূলের ‘আদি অংশ’। নয়ের দশক থেকে যাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস এবং পরে তৃণমূল কংগ্রেস করে চলেছেন, সন্দেশখালিতে এখন তৃণমূলের রাশ তাঁদের হাতেই। প্রশ্ন ছিল, এই যে মিডিয়ায় এত নেতিবাচক রিপোর্ট, তৃণমূলের বিরুদ্ধে মারাত্মক সব অভিযোগ, কী করে ভোটার টানবেন?
সন্দেশখালি বাজারের দলীয় নির্বাচনী কার্যালয়ে বসে অঞ্চলের তৃণমূল আহ্বায়ক অচ্যুতানন্দ নস্কর বললেন, “সন্দেশখালির ভোটাররা খুব চালাক এবং বুদ্ধিমান। ফলে নকল বর্জন করে আবার আসল জায়গায় চলে আসছেন ভোটাররা। জমি নিয়ে মানুষের মনে ক্ষোভ জমেছিল, সেটা ‘দিদি’ প্রশমন করেছেন। নোনা জল ঢোকানো জমি ফেরত চাইছিলেন অনেক, কিছু মানুষ টাকা পাচ্ছিলেন না, দিদির নির্দেশে সেই জমি এবং টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। ফলে মূল আন্দোলনে যাঁরা ছিলেন, তাঁরাও এখন খুশি।”
জমি-বেনিয়ম নিয়ে জমতে থাকা সাধারণ মানুষের ক্ষোভ, তার বিস্ফোরণ এক আন্দোলনে কার্যত মান্যতা দিচ্ছেন স্থানীয় তৃণমূল নেতারা। এ ব্যাপারে প্রশ্ন ছিল, তা হলে কি তৃণমূলও মেনে নিচ্ছে কেলেঙ্কারি একটা ঘটেই চলেছিল? আন্দোলনটা না হলে যেটা সামনে আসছিল না? ওই তৃণমূল নেতা বলেন, “এই ক্ষোভটা এক দিনে হয় না। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষোভ জমছিল। মানুষের কাছে জমি হচ্ছে প্রাণ। সেই জমিটা যখন হারিয়ে যায়, জমি লিজের টাকা যদি না পান, সেই ক্ষোভটা কোন জায়গায় পৌঁছোতে পারে, সেটা সবাই অনুমান করতে পারেন।” প্রশাসন জানত না?
একটু ঘুরিয়ে হলেও ওই তৃণমূল নেতার স্বীকারোক্তি, “দলের দায়িত্বে থেকে কেউ যদি স্বৈরাচারী হয়, তখন তার বিরুদ্ধে মুখ থুলতে গেলে যে শক্তির দরকার, সেটাই তারা পাচ্ছিল না। ফলে প্রশাসনে যাব, না কি অন্য কোনো কোথাও যাব, কার কাছে গেলে একটা সুরাহা পাব, মানে মানুষ তখন দিশাহারা হয়ে পড়েছিল। তার পর পুঞ্জীভূত ক্ষোভ একত্রিত হল, এই আন্দোলনটা হল। এটা সাধারণ মানুষের আন্দোলন, কোনো দলীয় আন্দোলন নয়। এটা কয়েকজন ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে আন্দোলন। আন্দোলনকারীরা নিজেরাই তো বলেছিলেন, আমরা তৃণমূল দলটাই করি। কিন্তু দলগত ভাবে তৃণমূল সেই আন্দোলনে রাজনৈতিক ভাবে মাথা গলাতে যায়নি।”
সন্দেশখালি নিয়ে গুটিকয়েক তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে একটা বৃহত্তর বঞ্চিত মানুষের আন্দোলনের কথাই বড়ো করে তুলে ধরতে চাইছে তৃণমূল। সেই তৎকালীন নেতাদের অত্যচার যে শুধু বিরোধীদের সইতে হয়েছে, সে কথাও মানতে নারাজ তৃণমূলেরই একাংশ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক তৃণমূল নেতা বলেন, “শাহজাহান-উত্তমদের কাছে আমাদেরও লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। তারা এখন যেখানে আছে, ভালোই আছে। এলাকার মানুষ আশ্বস্ত হচ্ছেন, নির্ভয়ে আছেন, সে কথা তারা আমাদেরও বলছে”। এখন দেখার,সন্দেশখালি নিয়ে স্থানীয় তৃণমূলের এই সরল স্বীকারোক্তি বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রে ঘাসফুলের পালে কতটা হাওয়া জোগায়!
আরও পড়ুন: মাছের ভেড়ি নিয়ে ‘পলিসি’ আনছে রাজ্য সরকার, বসিরহাটের প্রচার সভায় জানালেন মুখ্যমন্ত্রী