উজ্জ্বল বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়নগর: জয়নগর মজিলপুর বহু বিপ্লবীর জন্মস্থান। যাঁরা স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে গেছেন দেশকে স্বাধীন করার জন্য। সেরকমই এক জন বিপ্লবী ছিলেন বিপ্লবী শহীদ কানাইলাল ভট্টাচার্য। যিনি নিজের জীবন দিয়ে শহিদ হয়েছিলেন।
বিপ্লবীকে মনে রেখেই প্রতিবছরের মতো এ বছরও বিপ্লবী কানাই লাল ভট্টাচার্য স্মৃতি রক্ষা কমিটির উদ্যোগে বৃহস্পতিবার জয়নগর মজিলপুর দত্তবাজারে তাঁর মূর্তির পাদদেশে ৯৩তম আত্মাহুতি দিবস পালন করা হল। এ দিনের অনুষ্ঠানে হেরিটেজ কমিটি ফর গ্রেটার জয়নগর-সহ পুর এলাকার বহু ক্লাব, সংগঠন সহ বহু মানুষ অংশ নেন।
এ দিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জয়নগর মজিলপুর পুরসভার চেয়ারম্যান সুকুমার হালদার, ভাইস চেয়ারম্যান রথীনকুমার মণ্ডল, প্রাক্তন বিধায়ক তরুণকান্তি নস্কর, প্রাক্তন চেয়ারম্যান প্রশান্ত সরখেল, সুজিত সরখেল, কানাইলাল ভট্টাচার্য স্মৃতি রক্ষা কমিটির সম্পাদক রমাপ্রসাদ চক্রবর্তী, ডা: রামপ্রসাদ মণ্ডল, লালমোহন ভট্টাচার্য-সহ আরও অনেকে।
এ দিন সকালে জয়নগর মজিলপুর পুরপ্রাঙ্গণে বিল্পবী ও মনীষীদের মূর্তিতে মাল্যদান করা হয়। মূল অনুষ্ঠান হয় মজিলপুর দত্তবাজারে বিল্পবী কানাইলাল ভট্টাচার্যের মূর্তির পাদদেশে। এর পরে দুপুরে জয়নগর জেএম টেনিং স্কুলে বিপ্লবীর ছবিতে মাল্যদান করা হয় এবং সন্ধ্যায় সৃজনী সংঘের মাঠ থেকে দত্তবাজার পর্যন্ত মশাল মিছিল শুরু হয়ে দত্তবাজারে কানাইলাল ভট্টাচার্যের মূর্তির পাদদেশে এসে শেষ হয়। যাতে বহু মানুষ অংশ নেন। বিপ্লবীর জীবনের ইতিহাস তুলে ধরা হয় এ দিনের অনুষ্ঠানে।
কে এই বিপ্লবী কানাইলাল ভট্টাচার্য?
ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, ১৯৩১ সালের ২৭ জুলাই কানাইলাল ভট্টাচার্য (Kanailal Bhattacharjee) ‘বিমল দাশগুপ্ত’ ছদ্মনামে বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত ও বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসির দণ্ডাদেশকারী বিচারক আর আর গার্লিককে হত্যা করেন এবং পটাশিয়াম সায়ানাইডের ক্যাপসুল খেয়ে নেন। সেই অবস্থায় উপস্থিত প্রহরী সার্জেন্টের গুলি তাঁর শরীর ঝাঁঝরা করে দেয়। সে সময় তাঁর পকেটে একখণ্ড কাগজ পাওয়া যায়। তাতে লেখা ছিল, “ধ্বংস হও; দীনেশ গুপ্তকে ফাঁসি দেওয়ার পুরস্কার লও”।
মেদিনীপুরের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট পেডির হত্যার ব্যাপারে বিপ্লবী বিমল দাশগুপ্তকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল পুলিশ। তিনি ছদ্মনাম নিয়ে নিজের জীবনের বিনিময়ে বিমল দাশগুপ্তকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন। পুলিশ দীর্ঘ দিন তাঁর প্রকৃত পরিচয় উদ্ধার করতে পারেনি। এমনকী শনাক্তকরণের সময় কানাইলালের মহীয়সী মা পর্যন্ত তাঁর দেহ অস্বীকার করে বলেন, “এ তাঁর কানু নন”।
মাত্র ২২ বছর বয়সে নামহীন, পরিচয়হীন শহিদ হয়ে থেকে, অপর এক বিপ্লবীকে বাঁচিয়ে যাওয়ার এই চেষ্টা ইতিহাসে বিরল। ১৯০৯ সালের ২২ আগস্ট কানাইলাল ভট্টাচার্যের জন্ম হয় দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার জয়নগর থানার মজিলপুরের দেওয়ান বংশে। তাঁর পিতার নাম নগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ও মাতা কাত্যায়নী দেবী।
তিনি জয়নগর-মজিলপুর, বহড়ু, বিষ্ণুপুর ব্যায়াম সমিতির সভ্য ছিলেন। ছাত্রাবস্থায় আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, বাঘাযতীনের বুড়িবালামের যুদ্ধ, মাস্টারদার জালালাবাদ পাহাড়ে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি যুবক বয়সেই স্বাধীনতা বিপ্লব আন্দোলনে যোগ দেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স দলের সদস্য ছিলেন তিনি। বহড়ুর বিপ্লবী সুনীল চট্টোপাধ্যায়, বোড়ালের সাতকাড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সুপরিচিত বিপ্লবীদের সংস্পর্শে আসেন এবং একজন বিপ্লবী আন্দোলনের যোদ্ধায় পরিণত হন।
তিনি মজিলপুর জেএম ট্রেনিং স্কুলের ছাত্র ছিলেন। আলিপুর জেলা সদরের ঠিকানা এখনও বিপ্লবী কানাইলাল ভট্টাচার্যের নামে উল্লেখিত। বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগে ১৩ -১৪ বছর আগে এই দিনটিকে পালন করা হতো। বর্তমানে সরকারি উদ্যোগে দিনটি পালন না করা হলেও বেসরকারি উদ্যোগে গঠিত বিপ্লবী কানাইলাল ভট্টাচার্য স্মৃতিরক্ষা কমিটি এই দিনটি পালন করে মজিলপুর দত্ত বাজারে বিপ্লবীর বাড়ির পাশে তাঁর আবক্ষ মূর্তির সামনে।
আরও পড়ুন: বিশ্ব ম্যানগ্রোভ দিবস: বন দফতরের উদ্যোগে কুলতলি-সহ সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় ম্যানগ্রোভ চারা রোপণ