শম্ভু সেন
পিঠোপিঠি দুই কন্যা। বয়সের তফাত এক মাসও নয়। একজনের জন্ম ১৯২৪-এর সেপ্টেম্বরে, অন্যজনের জন্ম ওই বছরেরই অক্টোবরে। দুই প্রবাদপ্রতিম সংগীতশিল্পী সুচিত্রা মিত্র ও কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুলত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী হলেও এঁরা দু’ জনেই অন্যদের গান গেয়েছেন, অন্য ধরনেরও গান গেয়েছেন। দুই কিংবদন্তী শিল্পীর জন্মশতবর্ষে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করল ‘বৈতালিক’, বুধবার সন্ধ্যায় রবীন্দ্র সদনে তাদের ২৩তম জন্মদিনের অনুষ্ঠানে।
তিনটি উদ্বোধনী সংগীতের মাধ্যমে সূচনা হল এ দিনের অনুষ্ঠানের – ‘সুরের গুরু দাও গো সুরের দীক্ষা’, ‘ভুবনজোড়া আসনখানি’, এবং ‘তোমার সুরের ধারা ঝরে যেথায় তারি পারে’। শুরুতেই বৈতালিক শিল্পীগোষ্ঠীর এই পরিবেশনা অনুষ্ঠানের মূল সুরটাকে বেঁধে দিল।
তার পরেই শুরু হল অনুষ্ঠানের মূল পর্ব – ভাষ্য-সহ সংগীতানুষ্ঠান ‘দুই কন্যা’। সংগীতজীবনের বিভিন্ন সময়ে কণিকা ও সুচিত্রার রেকর্ড করা ১৩টি করে গান, মোট ২৬টি গান পরিবেশিত হল। তার সঙ্গে ভাষ্যে থাকল সেই গানগুলির কিছু ইতিহাস, কিছু প্রেক্ষাপট। গানগুলির বেশির ভাগই রবীন্দ্রসংগীত। আর ছিল অতুলপ্রসাদ, হরিনাথ মজুমদার তথা কাঙাল হরিনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সলিল চৌধুরীর গান।
কণিকা সম্পর্কে সুচিত্রা মিত্র বলেছিলেন নামেই শুধু মোহর নয়, তার গানেও রয়েছে সোনার ছোঁয়া। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুচিত্রা মিত্রের মূল ক্ষেত্র রবীন্দ্রসংগীত হলেও, তাঁরা গেয়েছেন অতুলপ্রসাদী, ব্রহ্মসংগীত, আধুনিক, ভজনও। শুধু গাওয়াই নয়, রেকর্ডও করেছেন। কার্যত শান্তিনিকেতনে বড়ো হওয়া, রবীন্দ্রনাথের কাছে গান শেখা কণিকার প্রথম রেকর্ডই আধুনিক গানের। ১৯৩৮-এ রেকর্ড করেন নীহারবিন্দু সেনের কথায়, হরিপদ চট্টোপাধ্যায়ের সুরে দুটি আধুনিক গান। ব্যথিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সে বছরই কণিকাকে দিয়ে রেকর্ড করান ‘মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে’ আর ‘ডাকব না, ডাকব না’। ‘মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে’ পরিবেশন করে দেবারতি সোম সূচনা করলেন ‘দুই কন্যা’ পরিবেশনা। রবীন্দ্রনাথের গানে আছে বিষাদেরও সুর। মাত্র কুড়ি বছর বয়সেই লিখেছিলেন ‘কিছুই তো হল না’। সাতের দশকে কণিকার রেকর্ড করা সেই গান পরিবেশন করলেন দেবারতি। শ্রোতা-দর্শকরা মুগ্ধ হয়ে শুনলেন।
অক্ষয়চন্দ্র সরকার ও সারদাচরণ মিত্রের সংকলিত প্রাচীন কাব্যসংগ্রহের মৈথিলি ভাষামিশ্রিত কবিতাগুলির প্রতি কৈশোরেই আকৃষ্ট হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। অক্ষয়বাবুর কাছ থেকে জেনেছিলেন ইংরেজ বালককবি চ্যাটার্টনের কথা। তিনি প্রাচীন কবিদের নকল করে কবিতা লিখতেন। রবীন্দ্রনাথ ‘জীবনস্মৃতি’তে লিখেছেন, ‘কোমর বাঁধিয়া দ্বিতীয় চ্যাটার্টন হইবার চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইলাম।’ জন্ম হল ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’। সেখান থেকে কণিকার রেকর্ড করা দুটি গান পরিবেশিত হল। প্রথমে সম্মেলক গান ‘শুন লো শুন লো বালিকা’। দ্বিতীয়টি ‘শাঙনগগনে ঘোর ঘনঘটা’। রবিকবির এই গানটি তাঁর গীতি-সংকলন ‘গীতবিতান’-এ ‘প্রকৃতি’ পর্যায়ে ‘বর্ষা’র গান হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়। দেবারতির কণ্ঠে ‘শাঙনগগনে ঘোর ঘনঘটা’ মন ভরিয়ে দেয় শ্রোতা-দর্শকদের।
প্রকৃতিকে আমাদের চিনতে শিখিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তবে বর্ষা আর বসন্তের প্রতি তাঁর পক্ষপাত ছিল বেশি। বসন্তের দুটি গান কণিকা রেকর্ড করেছিলেন পাঁচের দশকে – ‘নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগল’ ও ‘আমার মল্লিকাবনে’। প্রথমটি পরিবেশিত হল সম্মেলক গান হিসাবে। স্বপন সোমের পরিবেশনা ‘আমার মল্লিকাবনে’ তৃপ্ত করল শ্রোতা-দর্শকদের। রবিকবি অনেক গানেই প্রকৃতিকে প্রেক্ষাপট হিসাবে ব্যবহার করেছেন। তেমনই একটি গান ‘আজ জ্যোস্নারাতে সবাই গেছে বনে’। গেয়ে শোনালেন স্বপন সোম। কণিকা এই গান রেকর্ড করেন ১৯৫৮ সালে।
এর পর দেবারতি সোম গাইলেন ‘লক্ষ্মী যখন আসবে’। রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের এই গান কণিকা রেকর্ড করেন ১৯৬৮-তে। দেবারতির পরিবেশনায় আবিষ্ট হয়ে থাকলেন শ্রোতা-দর্শককুল। স্বপন সোম শোনালেন ব্রহ্মসংগীত ‘সত্য মঙ্গল প্রেমময় তুমি’। কণিকা এই গান রেকর্ড করেন ১৯৭৭-এ। বিচিত্র নানা ভাবনার প্রতিফলন রবীন্দ্রনাথের ‘বিচিত্র’ পর্যায়ের গানে। এরই মধ্যে রয়েছে দেশাত্মবোধক গান। ১৯৬৩-তে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে একাধিক গান রেকর্ড করেছিলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। এরই মধ্যে একটি ‘আমরা নতুন যৌবনের দূত’ পরিবেশন করলেন দেবারতি সোম ও স্বপন সোম। দ্বৈতসংগীতে তাঁরা মাতিয়ে দিলেন প্রেক্ষাগৃহ।
রবীন্দ্রসংগীত ছাড়াও কণিকা রেকর্ড করেছিলেন অন্যান্য কবির গান। এর মধ্যে অন্যতম অতুলপ্রসাদী। কণিকা ১৯৫৭ সালে রেকর্ড করেন ‘ওগো নিঠুর দরদী’। স্বপন গেয়ে শোনালেন সেই গান। দেবারতি পরিবেশন করলেন হরিনাথ মজুমদার তথা কাঙাল হরিনাথের ব্রহ্মসংগীত ‘যদি ডাকার মতো ও পারিতাম ডাকতে’। কণিকা এই গান রেকর্ড করেন ১৯৭৮-এ। কণিকার কণ্ঠকে জাদুকরী কণ্ঠ বলে অভিহিত করেছিলেন কবি অরুণ মিত্র। ১৯৭৫-এ সেই জাদুকরী কণ্ঠে রেকর্ড করা ‘শেষ নাহি যে শেষ কথা বলবে’ পরিবেশিত হল সম্মেলক গান হিসাবে।
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় কবিগুরুর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন শৈশব থেকেই। আর সুচিত্রা মিত্র শান্তিনিকেতনে আসেন, তাঁর ১৭ বছর বয়সে, কবির প্রয়াণের কয়েক মাস পরে। কবিগুরুর সান্নিধ্য না পেলে কী হবে, কবির গানের সঙ্গে হয়ে গিয়েছিল তাঁর আত্মিক সম্পর্ক। সুচিত্রা ১৯৪৫ সালে রেকর্ড করেন ‘হৃদয়ের এ কূল ও কূল’। সম্মেলক গান হিসাবে পরিবেশিত এই গান সকলের হৃদয় ছুঁয়ে গেল। সুচিত্রার গান সম্পর্কে ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, সে বেশ গলা ছেড়ে গান গায় আর তার গানে রয়েছে সাবলীলতা। ১৯৬৫ সালে রেকর্ড করা ‘লিখন তোমার ধুলায় হয়েছে ধূলি’ গেয়ে শোনালেন স্বপন সোম।
কালের নিয়মে যেটুকু পরিবর্তন হওয়া। এ ছাড়া সুচিত্রার গায়ন কিন্তু বরাবরই একরকম। ১৯৬২-তে সুচিত্রা রেকর্ড করেন বর্ষার গান ‘আজ আকাশে মনের কথা’। দেবারতির পরিবেশনা যেন সেই পরিবেশটিই তৈরি করল। ১৩১২ বঙ্গাব্দের ভাদ্র-আশ্বিন-কার্তিক, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়। সেই সময় রবীন্দ্রনাথ ২৪টি স্বদেশি সংগীত লেখেন। এর মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত গানটি হল ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ’। এই গানটি সুচিত্রা রেকর্ড করেন ১৯৪৮ সালে। এ দিনের অনুষ্ঠানে সম্মেলক গান হিসাবে পরিবেশিত হল এই গান।
১৯৪৬-এর অগস্ট। রক্তাক্ত ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায় যখন কলুষিত কলকাতা। দাঙ্গার বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছিলেন লেখক-শিল্পীরা। তাঁদের অন্যতম চিন্মোহন সেহানবীশ। তাঁর কথায়, “মনে পড়ে দাঙ্গার বিরুদ্ধে লেখক ও শিল্পীদের সেই অপূর্ব অভিযান। রাস্তার মোড়ে মোড়ে যখন সে মিছিল পৌঁছাচ্ছিল, নিমেষের মধ্যে মিছিলের গাড়িগুলিকে ঘিরে ফেলছিল হাজার হাজার শব্দাতুর মানুষ। তাঁদের মুখের দিকে চেয়ে ট্রাকের উপরে দাঁড়িয়ে সুচিত্রা মিত্র গান ধরলেন, ‘সার্থক জনম আমার…।” এই গান সুচিত্রা রেকর্ড করেন ১৯৪৮-এ। এই গান শোনালেন দেবারতি। তাঁর কণ্ঠে এই গান এক ভাবগম্ভীর পরিবেশ তৈরি করল।
গত শতকের চারের দশক ছিল সুচিত্রার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যোগ দিয়েছেন গণনাট্য সংঘে, গাইছেন গণচেতনার গান, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া অন্য কবিদেরও। রবীন্দ্রনাথের ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’র অনুকরণে ১৯৫০-এ গান বেঁধেছিলেন সলিল চৌধুরী – ‘সেই মেয়ে’ – ‘হয়ত তাকে দেখেনি কেউ,/ কিংবা দেখেছিল।/ ছিন্নশত আঁচল ঢেকে জীর্ণ দেহখানি/ ক্লান্ত পায়ে পায়ে যেতে পথে/ কী জানি কী ঝড়ে,/ গেছে বুঝি ঝ’রে/ জীবনের তরু থেকে –/ তখন গগন ছড়ায় আগুন দারুণ তেজে/ সেই মেয়ে’। সলিলের এই গান সুচিত্রা রেকর্ড করেন ১৯৫০-এই। আর মূল ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’ রেকর্ড করেন ১৯৬১-তে। এ দিন দুটি গানই পরিবেশিত হল। দেবারতি গাইলেন ‘কৃষ্ণকলি’, মন ভরে গেল শ্রোতা-দর্শকদের, আর স্বপন শোনালেন ‘সেই মেয়ে’। এই গানে নানা জায়গায় সুরের অসম্ভব বাঁক। স্বপনের নিখুঁত পরিবেশনায় মুগ্ধ সকলে।
রবীন্দ্রনাথের ৫০ বছর বয়সে লেখা নাটক ‘অচলায়তন’-এর গান ‘কঠিন লোহা কঠিন ঘুমে ছিল অচেতন’। শিলাইদহে লেখা ওই গান সুচিত্রা রেকর্ড করেন ১৯৮৪-তে। সেই গান সম্মেলক গান হিসাবে পরিবেশিত হল। এর পরেই স্বপন শোনালেন ‘এ কি এ মোহের ছলনা’। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন কিন্তু প্রাপ্য স্বীকৃতি পাননি। রবীন্দ্রনাথের সেই জ্যোতিদাদার লেখা গান ‘এ কি এ মোহের ছলনা’ সুচিত্রা মিত্র রেকর্ড করেন ১৯৭৬। বিভিন্ন রচয়িতার ব্রহ্মসংগীত, আধুনিক, ভজন ছাড়াও সুচিত্রা গেয়েছেন অতুলপ্রসাদের গান। ১৯৫৭-য় সুচিত্রা রেকর্ড করেন ‘একা মোর গানের তরী’। বড়ো আর্তিময় গান। দেবারতির কণ্ঠে যথার্থ ফুটে উঠল সেই আর্তি।
সুচিত্রা মিত্র বেশ কিছু বাংলা ছবিতে নেপথ্য সংগীত গেয়েছেন। ১৯৪৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘কামনা’ ছবিতে গেয়েছিলেন ‘ডেকো না আমারে ডেকো না’ আর ‘এই করেছ ভালো’। স্বপন সোম শোনালেন ‘এই করেছ ভালো’। কবির ৬৪ বছর বয়সের একটি গান – ‘পথে যেতে ডেকেছিলে মোরে’। সুচিত্রা রেকর্ড করেন ১৯৫৬ সালে। ‘নটীর পূজা’র ওই গান গাইলেন দেবারতি।
সব শেষে পরিবেশিত হল সম্মেলক গান ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’। কবির সমগ্র জীবনদর্শন এই গানে প্রতিফলিত। সুচিত্রা মিত্র এই গান রেকর্ড করেন ১৯৫২ সালে। কবি চেয়েছিলেন এই গান আমাদের সকলের গান হয়ে উঠুক।
দেবারতি সোম, স্বপন সোম ও বৈতালিক শিল্পীগোষ্ঠীর গান এবং সৌরভ ঘোষের ভাষ্যপাঠে সমগ্র অনুষ্ঠানটি প্রাণময় হয়ে ওঠে। এ দিন যন্ত্রানুষঙ্গে ছিলেন দেবাশিস সাহা, স্বাগতম দাস, দেবাশিস হালদার এবং অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। সমগ্র অনুষ্ঠানটি পরিচালনা দেবারতি সোম।
‘বৈতালিক’-এর অনুষ্ঠান সব সময় মন ভরিয়ে দেয়। ঋদ্ধ করে শ্রোতা-দর্শকদের। তাঁদের পাওয়ার ঝুলিটা ভরে যায়। এ দিনও তার অন্যথা হল না। অনুষ্ঠান শেষে খুব সংক্ষিপ্ত ভাষণে সুচিত্রা মিত্র ও কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলেন স্বপন সোম। বললেন, “এই দুই কিংবদন্তি শিল্পীর প্রতি এ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ শুধু ‘বৈতালিক’-এর পক্ষ থেকে নয়, শ্রোতা-দর্শকদের পক্ষ থেকেও।”
ছবি: সৌজন্যে ‘বৈতালিক’
আরও পড়ুন
‘কালিন্দী নাট্যসৃজন’-এর ২৪তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে মঞ্চস্থ হল যুগোপযোগী নাটক ‘বহমান’